মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
ভারতের বিহার রাজ্যের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নাম গেহলার। পাহাড় ঘেরা নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এই গ্রামের মানুষদের কাছে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অনেক সুবিধাই অনুপস্থিত। বিহারের দরিদ্রতম এলাকাগুলোর একটি এটি। এখানে সুপেয় পানি, প্রয়োজনীয় খাবার, সেনিটেশন সব কিছুরই অভাব। এর সবচেয়ে কাছের শহর গয়া, যা ধর্মীয়ভাবে খুবই সম্মানিত। গয়া শহর এবং এই গ্রামটির মাঝখানে বিশাল এক পাহাড় আড়াল করে রাখায় ৫৫ কিলোমিটার ঘুর পথে পায়ে হেঁটে শহরটিতে যেতে হতো।
এই গ্রামেরই এক বাসিন্দার নাম দশরথ মাঝি। ১৯৩৪ সালে তিনি জন্মেছেন হতদরিদ্র ও চরম রক্ষণশীল মুশার পরিবারে, বর্ণ ভেদে যা নিম্নবর্গেরও নিচের স্তরের। তীব্র অভাবের কারণে তিনি এক পর্যায়ে চলে যান ঝাড়খ- রাজ্যের ধানবাদে। সেখানে কয়লা খনির শ্রমিকের কাজ করেন সাত বছর। এরপর গ্রামে ফিরে এসে কাঠ কেটে জীবন কাটাতে থাকেন। সমাজের রীতি অনুসারে কিশোর বয়সেই বিয়ে করেন ফাল্গুনী দেবীকে। কিন্তু তার কোনো আর্থিক সংস্থান না থাকায় ফাল্গুনীর বাবা মেয়েকে তার কাছে নিয়ে যান। যখন দশরথ গ্রামে ফিরে এলেন তখন আবার তার সঙ্গে ফাল্গুনীর সংসার করার সুযোগ হয়। কারণ তখন তার কাছে কিছু অর্থ ছিল। ফাল্গুনীকে ফিরে পাওয়া ছিল তার জীবনের অন্যতম আনন্দময় ঘটনা। তাদের সংসারে একটি ছেলে হয়। দশরথ পাহাড়ে যেতেন কাঠ কাটতে বা পাথর কুড়াতে। ফাল্গুনী তার জন্য খাড়া পাহাড় বেয়ে খাবার নিয়ে যেতেন। ১৯৬০ সালে ফাল্গুনী দ্বিতীয়বারের মতো সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন।
একদিন কাজ করার সময় দুপুর গড়িয়ে গেলেও ফাল্গুনীকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন দশরথ। তিনি পাহাড় থেকে নামা শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি খবর পান তার জন্য খাবার নিয়ে পাহাড়ে উঠার সময় ফাল্গুনী পা ফসকে নিচে পড়ে গিয়েছেন। ফাল্গুনী তখন সন্তান জন্ম দেয়ার দিন আসন্ন। দৌড়ে যান দশরথ। প্রিয়তমা স্ত্রীকে উদ্ধার করে তিনি ছুটতে থাকেন। কারণ তার গ্রামে বা আশেপাশে হসপিটাল বা চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই।
পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে সত্তর কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন দশরথ। তারপর যখন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে যান তখন তার স্ত্রী প্রচুর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ। স্থানীয় চিকিৎসকরা চেষ্টা করেন। কিন্তু একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দিয়ে ফাল্গুনী মারা গিয়েছেন। এই কথা কিছুতেই দশরথের মাথায় ঢোকে না। তিনি নির্বাক হয়ে পড়েন। ফাল্গুনীর মৃত্যু কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি শুধু ভাবেন যদি এতো দূরত্ব পাড়ি দিতে না হতো তাহলে হয়তো ফাল্গুনী বেঁচে যেতেন।
গ্রামে ফিরে এসে তিনি পাহাডের কাছে যান। তার শোক এক অনন্য শক্তিতে পরিণত হয়। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন এই পাহাড় কেটে তিনি পথ তৈরি করবেন। ঘরের একমাত্র গবাদি পশুটি বিক্রি করে তিনি একটি হাতুড়ি আর শাবল কেনেন। তারপর চলে যান পাহাড়ে। সবাই ভাবে স্ত্রীর মৃত্যুতে পাগল হয়ে গেছেন দশরথ। তার বাবা ও গ্রামের লোকজন তার কাছে এসে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন এতো বড় পাহাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করা একজন মানুষের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব নয়। তিনি যেন এ কাজ থেকে ফিরে আসেন। কিন্তু দশরথের এক জবাব, পথ তৈরি না করে তিনি ফিরবেন না। এটা তার মৃত স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য মনে করেন। আর কারো যেন তার মতো দুঃখজনক মৃত্যু না হয়। সবাই সহানুভূতি প্রকাশ করলেও সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসে নি। সবাই দেখে প্রতিদিন এক ‘পাগল’ পাহাড় কাটতে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বিষয়টি তাদের সয়ে গেল। কারণ তারা জানে দশরথ একা কোনো দিনই এ কাজ করতে পারবেন না। কেননা এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্যও আসবে না। আর পাহাড় কাটার জন্য যে সরঞ্জাম ও লোকবল প্রয়োজন তাও দশরথের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বিদ্রূপ করে বলে, ‘পাহাড় কাটার কতোদূর হলো মাঝি!
দশরথ একা তার কাজ করতে লাগলেন। পাহাড়ের পাথরে আঘাত করতে গিয়ে শাবল উল্টো আসে তার দিকে। পা কেটে যায়। শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু নিজের চেষ্টায় অটল দশরথ। প্রতিদিন ভোর চারটায় তিনি পাহাড়ে চলে যেতেন, টানা কাজ করতেন রাত আটটা পর্যন্ত। প্রায় দিনই তিনি খাবার এবং পানি ছাড়া কাজ করতেন। কখনো নোংরা পানি এবং গাছের পাতা খেয়েছেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। মাঝে মাঝে লোকজনের জিনিস পাহাড় পার করে দিয়ে যা জুটতো তাই দিয়ে খরচ যোগাতেন। গ্রাম জুড়ে তীব্র খাবারের অভাবে তার আত্মীয়রা তাকেও তাদের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। কিন্তু দশরথ নির্বিকার। দশ বছরের একক চেষ্টায় পাহাড়ের গায়ে বেশ বড় চিড় ধরিয়ে ফেললেন তিনি। এরপর কেউ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে অনিয়মিত ভাবে। মাঝে কিছু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এলেও তা আর বাস্তব রূপ পায় নি। একবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পদে পদে লাঞ্ছিত হয়ে ব্যর্থ মনে ফিরে এসেছেন।
১৯৮২ সাল। বাইশ বছর। দশরথ ততোদিনে শুধু পাহাড় টলিয়ে দেন নি, পাহাড়কে দুই ভাগ করে তার মধ্য দিয়ে পথ তৈরি করে শেষ পাথরটিকে সরালেন। পাহাড়ের ২৫ ফিট বুক চিড়ে ৩৬০ ফিট লম্বা এবং ৩০ ফিট প্রশস্ত পথটি যখন তৈরি হলো তখন শহরের সঙ্গে গ্রামের দূরত্ব কমে এলো ১৫ কিলোমিটারে। সরকারি ভাবে পথটির নাম হয়, দশরথ মাঝি রোড।
সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর একুশ বছর ধরে প্রায় বিশ হাজার কর্মী দিয়ে তৈরি করেছিলেন তাজমহল। সারা পৃথিবীর মানুষ তাজমহলকে ভালেবাসার প্রতীক হিসেবে চেনে। অপরদিকে দশরথ মাঝির ভালোবাসার প্রকাশ তার এই পথ। বনফুলের ছোট গল্পের সাজাহান চরিত্রের মতো স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশে নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। একে ‘গরীবের তাজমহল’ বলা হলেও তার মন গরীব ছিল না। তার জীবন নিয়ে ২০১৫ সালে ‘মাঝি দি মাউনটেন্ট ম্যান’ নামে একটি হিন্দি মুভি তৈরি হয়েছে ভারতে। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনয় করেছেন মাঝির চরিত্রে। ২০১৬ সালে দশরথ মাঝির ওপর একটি ডাকটিকেট প্রকাশ করে ভারতীয় ডাক কর্তৃপক্ষ।
বিহার সরকার দশরথ মাঝিকে পাঁচ একর জমি দান করে। কিন্তু দশরথ মাঝি সেই জমি নিজে না নিয়ে হসপিটাল করার জন্য দান করেন। ২০০৭ সালে গল
ব্লাডার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দশরথ মাঝি মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি আর ‘পাগল’ নন, ‘দশরথ বাবা’ নামে পরিচিত।
লেখক পরিচিতি; সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply