বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেশি দিনের কথা নয়, গত ফাল্গুন মাসের কথা। দোলের ছুটিতে গালুডি বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে বলি যে সিংভূম জেলার এই অঞ্চলে আমি অনেকবার গিয়েচি এবং এখানে আমার কয়েকটি বন্ধু বাড়িও করেচেন, ছুটি-ছাটাতে গিয়ে কিছুদিন যাপন করবার জন্যে।
গালুডি ক্ষুদ্র গ্রাম, এ থেকে চার পাঁচ মাইল দূরে দূরে সব দিকেই পাহাড়ের শ্রেণী ও জঙ্গল। দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবর্ণরেখার ওপারে সিদ্ধেশ্বর ও ধনঝরি শৈলমালা, তার ওদিকে তামাপাহাড় নামে একটি অনুচ্চ পাহাড়, এখানে কয়েক বৎসর পূর্বে একটা তামার খনি ছিল, কোম্পানি ফেল হয়ে যাওয়াতে ঘর, বাড়ি, কারখানা, চিমনি, ম্যানেজারের বাংলো সবই পড়ে আছে, মানুষ জন নেই। জায়গাটার নাম রাখা মাইন্স্। এই নামে একটা ছোট রেলস্টেশনও আছে দেড় মাইল দূরে। রাখা মাইন্স্ এবং তার আশেপাশে ঘন জঙ্গল ও পাহাড়, মাঝে সাঁওতালী বন্য গ্রাম। এই সব বনে হস্তী আছে, শঙ্খচূড় সাপ আছে, ভাল্লুক তো আছেই। এই জঙ্গলে যখন-তখন চলাফেরা করা বিপজ্জনক, বন্দুক না নিয়ে কখনও যাওয়া উচিত নয়।
এই পরিত্যক্ত নির্জন স্থানে একটা ভগ্নপ্রায় খড়ের বাংলোতে এক মাদ্রাজী কবিরাজ থাকতেন, তাঁর সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল। তাঁর মুখে গল্প শুনেচি-কিছুদিন আগে দুই বুনো হাতীর লড়াই হয়েছিল পুরোনো কারখানার কাছে। দুদিন ধরে লড়াই হয়, শেষকালে একটা হাতী মারা যায়। বেশি রাত্রে তাঁর বাংলোর বারান্দায় বাঘ ডাকে, সম্পূর্ণ দিনের আলো না ফুটলে তিনি কখনও বাংলোর বারান্দার দিকের দোর খোলেন না।
আমি ইতিপূর্বে অনেকবার যখন গালুডি গিয়েচি, তখন রাখা মাইনস্ ও তার আশেপাশের বনে বেড়াতে গিয়েচি একা একা। একা যাওয়ার কারণ প্রথমত তো ওসব বনের মধ্যে স্বাস্থ্যান্বেষী, অজীর্ণ-রোগগ্রস্ত শৌখীন কলকাতার বাবুরা পায়ে হেঁটে যেতে রাজী হন না, দ্বিতীয়ত গভীর বনের মধ্যে বেড়ানোর শখও সবার থাকে না-এতে তাঁদের দোষ দেওয়া চলে না অবশ্য। অনেকবার বেড়িয়ে বনের মধ্যে কিছু কিছু জায়গা পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। পরিচয় যখন ঘনিষ্ঠ হয় তখন লোকে স্বভাবতই সেখানে একটু অসতর্ক হয়ে পড়ে। আমিও তাই হয়েছিলাম; ওদেশে বনে বেড়াতে হলে সাধারণত সকালের দিকে যাওয়াই নিয়ম, বেলা দুটো তিনটের পর অর্থাৎ পড়ন্ত বেলার দিকে বনের মধ্যে থেকে বার হয়ে লোকালয়ের দিকে আসাই ভালো।
প্রথম প্রথম এ-নিয়ম খুবই মেনে এসেচি। একজন করে সাঁওতাল গাইড্ সঙ্গে না নিয়ে বনে যেতাম না। একবার সিদ্ধেশ্বরডুংরি বলে প্রায় পনেরো শ’ ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলাম, সেবারও সঙ্গে ছিল একজন সাঁওতাল ছোকরা। পাহাড়ের ওপর অনেক উঁচুতে বুনো হাতীতে চারা কেঁদগাছ ভেঙে দিয়েচে সেই পথপ্রদর্শক সাঁওতাল ছোকরা আমায় দেখায়। চীহড় ফল, এক রকম বুনো সীমের মতো ফল, তার বীজ পুড়িয়ে খেতে ঠিক গোলআলুর মতো-সে-ই পুড়িয়ে খাইয়েছিল পাহাড়ের ওপরকার জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে। পাহাড়ের এক জায়গায় একটি গুহা দেখিয়ে বলেছিল, এ গুহা এখান থেকে সুবর্ণরেখার ওপার পর্যন্ত চলে গিয়েচে।
এ-সব অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য বড় সুন্দর। যাঁরা ঘন অরণ্যানী, নির্জন শৈলমালার সৌন্দর্য ভালবাসেন তাঁদের এ সব স্থানে আসা দরকার। বনের মধ্যে মাঝে মাঝে ক্ষীণকায়া পার্বত্য নদী-হয়তো হাঁটুখানেক জল ঝিরঝির করে বইচে পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে। দু-ধারেই জনহীন বনভূমি, কেঁদ পলাশ ও শালের জঙ্গল, ঘন ও প্রস্তরাকীর্ণ, কত বিচিত্র বন্যপুষ্প, কন্য শেফালির বন। বার বার যাতায়াত করতে করতে ভয় ভেঙে গেল। যখন নিজের চোখে কখনও ভাল্লুক দেখলাম না, বা বুনো হাতীর তাড়া সহ্য করতে হল না, তখন মনে হল অনর্থক কেন একজন গাইড় নিয়ে গিয়ে পয়সা খরচ করা। যেতে হয় একাই যাবো।
অর্থব্যয় ছাড়া গাইড় নিয়ে ঘোরার অন্য অসুবিধাও ছিল। ধরুন, এক জায়গায় চমৎকার বন্য-পুষ্পের শোভা, পাহাড়ের নীল চূড়া সুনীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, নিকটেই ক্ষুদ্র পার্বত্য ঝরনার মৃদু কলধ্বনি, বনস্পতিদের শাখায় শাখায় বন্য পক্ষীর কুজন, আমার মনে হল এখানে অদূরবর্তী শিলাখণ্ডে পিয়াল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি, আপন মনে প্রকৃতির এই নিরালা রাজ্যে বসে বনবিহগ-কাকলী শুনি; কিন্তু গাইড় দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসতে দেবে না, বলবে, “চলো বাবুজী, চলো, এখনও অনেক পথ বাকি।”-তা ছাড়া সঙ্গে লোক থাকলে মনের সে শান্ত, সমাহিত ভাবও আসে না।
এই সব কারণে ইদানীং একাই বেড়াতে যেতাম বনের মধ্যে। কিন্তু যে ঘটনার কথা এখানে বলবো, তার পূর্বে সুবর্ণরেখার ওপারে দু’তিন মাইল ছাড়া একা খুব বেশি দূরে যাই নি, বড় জোর গিয়েচি সিদ্ধেশ্বর পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশ পর্যন্ত। গিয়েচি, আবার বেলা পড়বার অনেক আগেই সুবর্ণরেখার তীরে ফিরে এসেচি।
দোলের ছুটিতে এবার গালুডি গিয়ে দেখি অপূর্ব নির্মেঘ নীল আকাশ। বনে বনে শাল- মঞ্জরির সুগন্ধ, নব বসন্তে নতুন কচি-পাতা-ওঠা শাল, কেঁদ, পিয়াল, মহুয়া, গাছে গাছে কুঁড়ি দেখা দিয়েচে। বসন্তের বন্যা এসেচে পাহাড়ী ঝরনার মতো নেমে বিচিত্র বর্ণে, বিচিত্র সজ্জায় বনে বনে।
একজন বৃদ্ধ সাঁওতালের মুখে শুনেছিলাম পাঁচ মাইল দূরে বনের মধ্যে এক জায়গায় একটা ছোটখাট জলপ্রপাত আছে-জায়গাটার নাম নিশিঝরনা। সেখানে নাকি বন আরও ঘন, পথে এক জায়গায় পুরোনো আমলের একটা দেউল আছে ইত্যাদি। জায়গাটা দেখবার খুব ইচ্ছে হল। দোলের আগের দিন বেলা দশটার মধ্যে কিছু খেয়ে নিয়ে জায়গাটার উদ্দেশ্যে বার হয়ে পড়লাম।
শীঘ্রই সুবর্ণরেখা পার হয়ে গিয়ে রাখা মাইন্স্-এর পথ ধরলাম। মুসাবনী রোড যেখানে রাখা মাইন্স্-এর চার নম্বর শ্যাফটের গভীর বনের মধ্যে গালুডির পাকা রাস্তার সঙ্গে মিশেচে-সেখানে পৌঁছতে বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। তারপর বাঁধা সড়ক ছেড়ে দিয়ে বাঁ দিকে কুলামাড়ৌ বলে একটা ক্ষুদ্র বন্যগ্রাম পার হয়ে পায়েচলা সুড়িপথ ধরে ধঝড়ি পাহাড়ের নিচেকার ঘন বনের মধ্যে ঢুকলাম! পথ যে আমার একেবারে অপরিচিত তা নয়, আর বেশিদূর অগ্রসর না হলেও কুলামাড়ৌ গ্রামে সাঁওতালী উৎসবে সাঁওতালী নৃত্য দেখতে এর আগেও একবার এসেচি। সুতরাং আমার মনে দ্বিধা বা ভয় থাকবার কথা নয়, ছিলও না।
কুলামাড়ৌ পেছনে ফেলে চলেচি, আমার ডাইনে ধরি পাহাড় সরু কন্য পথের সমান্তরাল ভাবে যেন বরাবর চলেচে উত্তর-দক্ষিণ কোণ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে। বন ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে তা বেশ লক্ষ্য করচি। কিছুদূর গিয়ে বাঁ দিক থেকেও আর একটা শৈলশ্রেণী যেন ক্রমশ ধন্কারির গায়ে মেশবার চেষ্টা করচে। যে অরণ্যাবৃত উপত্যকা দিয়ে আমি চলেচি সেটা যেন ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসচে। আমার জানা ছিল এই পথটা বনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এক জায়গায় ধরি পাহাড় পার হয়ে ওপারে চলে গিয়ে আবার মুসাবনী রোডের সঙ্গে মিশেচে। সুতরাং মনে কোন উদ্বেগ ছিল না। জানি, যেতে যেতে আপনা-আপনি মুসাবনী রোডে পড়বোই। নিশিঝরনা কোথায় আমার জানা ছিল না; আমি বনের মধ্যে যেতে যেতে কান খাড়া করে আছি কোথায় ঝরনার শব্দ পাওয়া যায়। এক জায়গায় সত্যিই শব্দ পাওয়া গেল জলের, সঁড়িপথটা ছেড়ে নিবিড়তর বনের মধ্যে ঢুকে দেখি একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য নদী উপলরাশির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে; তার দু’ধারে এক প্রকার বন্য গাছ-অজস্র বেগুনী রঙের ফুল ফুটে আছে। স্থানটি যেমন সুন্দর তেমনি স্নিগ্ধ, কতক্ষণ বসে রইলাম একটা শিলাখণ্ডে, উঠতে যেন ইচ্ছে করে না।
কিন্তু এই বনে থাকা তখন যে উচিত ছিল না, তা তখন বুঝি নি। প্রথমত তো বনের ও সব নিভৃত স্থানে বিশেষ করে যেখানে জল থাকে, সেখানে বাঘ থাকা বিচিত্র নয়, দ্বিতীয়ত বেলা গেল, পথ তখনও কত বাকি সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা ছিল না-অথবা ধারণা থাকলেও ভুল ধারণা ছিল। যখন আবার সুঁড়িপথটায় উঠলাম তখন বেলা বেশ পড়ে এসেচে। বনের এই অংশের শোভা অবর্ণনীয়। প্রথম বসন্তে কত কি বনের ফুল গাছের মাথা আলো করে রেখেচে, ধঝরির নীল সানুদেশ এক দিকে খাড়া হয়ে উঠেচে ডাইনে, শালমঞ্জরির সুবাসে উপত্যকার বাতাস নিবিড় হয়ে উঠেচে, বেলা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সে গন্ধটি যেন আরও বাড়চে; কতক্ষণ অন্যমনে চলেছি, সুড়িপথটা কখন হারিয়ে গেছে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ দেখি আমার সামনেই ধঝরি পাহাড়ের খুব উঁচু একটি অংশ, সেখানে পাহাড় টপকে ওপারে যাওয়ার কোন উপায় নেই-পথও নেই। স্থানটি সম্পূর্ণ জনমানবহীন। সেই কুলামাড়ৌ গ্রাম ছাড়িয়ে এসে আর লোকালয় চোখে পড়ে নি। বেলাও পড়েচে, একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তা ছাড়া সঁড়িপথটাই বা গেল কোথায়? বনের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পথ খুঁজতে গিয়ে আরও গভীর বনের মধ্যে ঢুকে গেলাম।
এ দিকে সূর্য হেলে পড়েচে। এ বনের মধ্যে আর বেশিক্ষণ দেরি করা উচিত হবে না। ভাবলাম, আর নিশিঝরনা দেখে দরকার নেই, এবার যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরি। কিন্তু কোথায় সে পথ? ক্রমে এমন সব জায়গার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখান দিয়ে আসবার সময় আসিনি তা বেশ বুঝলাম। বনের মধ্যে দিকভ্রান্ত হওয়া খুব সহজ, বিশেষ করে এ ধরনের নিবিড় বনের মধ্যে। কিন্তু আমি জানি ধনঝরি উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে বিস্তৃত, বিশেষত সূর্য যখন এখনও আকাশে দেখা যাচ্ছে, তখন দিক ভুলের সম্ভাবনা অন্তত নেই-এই একটা ভরসা ছিল মনে। কিন্তু ভরসা ভরসাই রয়ে গেল সেই পর্যন্ত, কোনও কাজে এল না। সূর্য ক্রমে পাহাড়ের আড়ালে অস্ত গেল। ছায়া ঘনিয়ে এল বনে। যদিও সামনে জ্যোৎস্না রাত্রি, তবুও এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে একা রাত্রি কাটানোর সম্ভাবনায় বিশেষ পুলকিত হয়ে উঠলাম না।
হঠাৎ মনে হল ধন্ঝরি পাহাড়ের ওপারেই তো মুসাবনী রোড। পাহাড়টা যদি কোনও রকমে টপকাতে পারি, এখনও রাত হয়নি, লোকালয়ে পৌঁছতে পারবো। নতুবা ঘনায়মান সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলো-অন্ধকারে যতই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরবো ততই সম্পূর্ণরূপে পথভ্রান্ত হয়ে পড়তে হবে। একটা জায়গায় মনে হল যেন ধরি একটু নিচু হয়েচে। এই ধরনের নিচু খাঁজ দিয়েই আমার জানা পায়ে-চলার সুঁড়িপথটা গেছে ঘন চুলের মধ্যে চেরা সিঁথির মতো; পার্বত্য পথের কোন চিহ্নই দেখছি না কোন দিকে, তবুও এই অপেক্ষাকৃত নিচু থাক টপকে ধনঝরির ওপারে যাওয়া খুব কঠিন হবে না মনে হয়।
জুতো খুলে হাতে নিলাম। পাহাড়ের কিছুদুর উঠে গিয়ে দেখি নিচে বনের মধ্যে যত অন্ধকার ওপর ততটা নয়। জ্যোৎস্না উঠলো, জ্যোৎস্না ফুটবে ভালো। প্রথম খানিকটা উঠেই মনে হল ভুল জায়গা দিয়ে পাহাড় পার হচ্ছি, এখান দিয়ে কখনও কেউ পাহাড় পার হয়নি-যেমন বড় বড় পাথরের চাঁই, তেমনি কাঁটা গাছ সর্বত্র। খালি পায়ে ধারালো পাথরের ওপর দিয়ে চলতে বিষম কষ্ট, অথচ জুতো পায়ে দেওয়াও চলে না।
পাহাড়ের ওপরে খানিকটা উঠে গেলাম দিব্যি। তারপরে এক জায়গায় গিয়ে দেখি সামনে একেবারেই খাড়াই দুরারোহ পাহাড় দেওয়ালের মত উঠেচে। বড় বড় গাছের শেকড় ঝুলচে, যেন জলের তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে পড়েচে। আমি শিক্ষিত পর্বতারোহণকারী নই, সেই খাড়া উত্তুঙ্গ পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে ওঠা আমার পক্ষে তাই সম্পূর্ণ অসম্ভব।
এদিক ওদিক চেয়ে দেখি একদিকে একটা মসৃণ প্রকাণ্ড শিলা আড়ভাবে শোয়ানো, সেখানা উচ্চতায় আন্দাজ কুড়ি-বাইশ হাত এবং চওড়ায় ত্রিশ-বত্রিশ হাত হবে। এ ধরনের পাথরকে এদেশে ‘রাগ’ বলে। ‘রাগ’ পার হওয়া বিপজ্জনক, কারণ হাত-পা দিয়ে ধরবার এতে কিছু থাকে না। তবে এখানা অন্তত ৬০ ডিগ্রি কোণ করে হেলে আছে বলে ভরসা হল; এই একমাত্র পথে পাহাড়ের ওপরের দিকে ওঠা চলবে এখন।
জুতো যখন পায়ে নেই এক রকম করে চার হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ‘রাগ’ পার হয়ে ওপরে উঠলাম। তারপরে ওঠার বিশেষ কষ্ট নেই, শুধু অর্জুন আর শুভ্র নিষ্পত্র শিববৃক্ষের জঙ্গল, বাঁকাভাবে চাঁদের আলো এসে শিববৃক্ষের দুধের মতো সাদা ধবধবে গুঁড়ির গায়ে পড়েচে। কারণ তখন প্রদোষের ঈষৎ অন্ধকার কেটে জ্যোৎস্না ফুটে উঠেচে। এক জায়গায় ওপর দিকে মনে হল যেন গাছে আগুন লেগে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কৌতূহল হল অত্যন্ত, আপনি আপনি গাছে কি করে আগুন লাগবে? ওপরে উঠে গিয়ে দেখি সত্যিই এক জায়গায় একটা মোটা শেকড়ের গা দিয়ে ধোঁয়া বার হচ্ছে-তবে কি ভাবে শেকড়ে আগুন লাগলো তা আজও বলতে পারি না।
তখন আমি অনেকখানি ওপরে উঠে গিয়েচি, নির্শ্বের উপত্যকার গাছপালার মাথা কোঁকড়া-চুল কাফ্রিদের মাথার মতো দেখাচ্ছে; চাঁদের আলো বনের নিবিড় অন্ধকার উপত্যকার মধ্যে এতটুকু ঢোকে নি, ওপর থেকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। আর আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে চারিদিকে ধরির বিভিন্ন চূড়ার বনরাজির মাথায় মাথায় শুভ্র ঢেউ। সে জনমানবহীন শৈলমালার ঊর্ধ্ব সানুতে জ্যোৎস্না-প্লাবিত শুক্লা চতুর্দশী রাত্রির শোভা যে দেখে নি তাকে বলে বোঝানো যাবে না সে কি অপূর্ব ব্যাপার। একা যেন আমি পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কোন দেবলোকে বিচরণশীল আত্মা; আমার চোখের সম্মুখে যে দৃশ্য দূর থেকে সুদূরে প্রসারিত, কোনও পার্থিব চক্ষু কোনদিন তা দর্শন করেনি। কিন্তু সেখান থেকে আমার মনে হল আমি সম্পূর্ণ ভুল করেচি, যে দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠেচি সেখান দিয়ে পাহাড় টপকাবার উপায় নেই-যতই উঠি ততই দেখি আমার চোখের সামনে অর্জুন ও শিববৃক্ষের সাদা সাদা সোজা গুঁড়িগুলো থাকে থাকে উঠে যেন স্বর্গে উঠেচে। অর্থাৎ পাহাড়ের শিখর দেশের তখনও পর্যন্ত কোনও পাত্তাই নেই। তাছাড়া ক্লান্তও খুব হয়ে পড়েচি। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে যেন ঢেঁকির পাড় পড়চে অতিরিক্ত শ্রমের ফলে। এই বন ভেঙে অতখানি উঠে ওপারের ঢালু দিয়ে নামতে পারবো বলে মনে হল না-তার চেয়ে যে পথে উঠেচি হাত-পা ভেঙে মরার চেয়ে নিম্ন উপত্যকায় নেমে জ্যোৎস্নার আলোয় আবার না হয় পথ খুঁজি। বিপদ এল এতক্ষণে এই নামবার সময়, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে; একেবারে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হল প্রায়। দুর্ঘটনা যখন আসে তখন এমনি অতর্কিতে আসে।
যতটা উঠেছিলাম জ্যোৎস্নার আলোতে একরকম করে নেমে এসে সেই ‘রাগ’ খানার কাছে পৌঁছলাম। ‘রাগ’ পার হয়ে নেমে গেলে উপত্যকা আর বেশি নিচে নয়।
‘রাগ’ বেয়েই নামতে হবে, কারণ অন্য দিকে নামবার কোন উপায় নেই। অথচ ‘রাগ’ এমন মসৃণ যে হাত পায়ে আঁকড়াবার কিছু নেই-এ ধরনের পাথর বেয়ে ওঠা বরং সহজ, কিন্তু নামা অত্যন্ত কঠিন। তাড়াতাড়িতে আর একটা ভুল করলাম, উপুড় হয়ে না নেমে চিৎ হয়ে নামতে গেলাম। যাই হোক, খানিকটা তো নামলাম দিব্যি, তারপর পাথরখানার ওপর দিকের যে প্রান্ত হাত দিয়ে ধরেচি সেটা ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে সড় সড় করে খানিকটা নামলাম। তারপর পাথরের গায়ে এক জায়গায় একরাশ শুকনো পাতা জমে আছে, সেখানটিতে পাথরের কোন খাঁজ আছে ভেবে যেমন পা নামিয়ে দিয়েচি অমনি শুকনো পাতার রাশ হড় হড় করে সরে গেল-সেই ঝোঁকে আমিও খানিকটা গড়িয়ে পড়লাম। অথচ পায়ে আটকাবার কোন খাঁজ বা উঁচু-নিচু জায়গা কিছুই পেলাম না।
তখন আমার অবস্থা সঙিন হয়ে উঠেচে। কোথাও কিছু ধরবার নেই-শ্লেটের মতো মসৃণ পাথরখানার কোন জায়গায়। আমি চিৎ হয়ে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় তার ওপর শুয়ে আছি এবং আঙুল টিপে বা সামান্য কিছু ধরে আছি, সেটা ছেড়ে দিলেই নিচের দিকে গড়িয়ে পাথরের নুড়ির স্তূপের ওপর গিয়ে পড়বো। যে পাথরের স্তূপ অন্তত ত্রিশ ফুট নিচে, তার ওপর পড়লে তীক্ষ্ণ ধারালো অসমান প্রস্তরখণ্ডে বিষম আহত হতে হবে। তারপর হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকলে এ জনশূন্য পাহাড়ের ওপরে কে-ই-বা উদ্ধার করচে? এ অবস্থায় মৃত্যু ঘটা বিচিত্র কি?
যখন আমি বুঝলাম আমি খুব বিপদগ্রস্ত তখন হাত-পায়ে যেন আর বল নেই। আঙুলে টিপে ধরব কি, আঙুলই অবশ হয়ে আসচে। এভাবে আর কিছুক্ষণ কাটলেই গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবো এবং সাংঘাতিক আহত হব। তখন মনে হল ওঠবার সময় পাথরখানার এ অংশ দিয়ে উঠি নি, কোণ ঘেঁষে উঠেছিলাম। সেখানে নিচে ছোটবড় অসমান শিলাখণ্ডের ধাপমতো ছিল, তখন দিনের আলো ছিল বলে দেখে শুনে ওঠবার সুবিধা ছিল, এখন রাত্রে বিশেষ করে ওপরের দিক থেকে নামবার সময় অতটা বুঝতে পারি নি।
উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে চাইলাম, জলে ডোবার পূর্ব মূহূর্তে মজ্জমান ব্যক্তি যেমন কোন আশ্রয় খোঁজে, তেমনি। হঠাৎ নজরে পড়লো হাত খানেক দূরে একটা অর্জুন গাছের মোটা শেকড় ওপরের একখানা শিলাখণ্ডের ফাটল থেকে বার হয়ে ঝুলচে। মরীয়ার মতো সাহসে ঝোঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে সেই শেকড়টি আঁকড়ে ধরতে গেলাম এবং ধরেও ফেললাম। এতে নিজেকে আরও বিপন্ন করেছিলাম-কারণ শেকড় হাতের নাগালে না এলে টাল খেয়ে পড়ে গিয়ে সজোরে নিচের প্রস্তররাশির উপর পড়ে চূর্ণ হয়ে যেতাম ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়লে হয়তো চোট খেয়ে বেঁচে যেতাম, এতে কিন্তু বাঁচবার সম্ভাবনা আদৌ ছিল না।
‘রাগ’ থেকে শেকড় ধরে নেমে এসে সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন ঝাল বেরুচ্ছে বলে মনে হল!-নিশ্চিন্ত দুর্ঘটনার হাত থেকে পরিত্রাণ পেলে যেমন হয় মানুষের। কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম করে নিয়ে হাত-পায়ের অবশ ভাবটা কাটিয়ে আবার নামতে আরম্ভ করলাম এবং পনেরো মিনিটের মধ্যেই ধরির উপত্যকার সমতল ভূমিতে পা দিলাম।
তখন আমার মনে সাহস বেড়ে গিয়েচে। গুরুতর দুর্ঘটনার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সমতল ভূমিতে কোন বিপদই আর আমার কাছে বিপদ নয়। তখন রাত আন্দাজ দশটা হবে মনে হল। জ্যোৎস্না খুব ফুটেচে, বনের মধ্যে আগের মতো অত অন্ধকার নেই। প্রথমে সেই পার্বত্য নদীর ধারে এসে পৌছলাম তার জলের কলধ্বনি শুনে। জল পান করে ও মাথায় মুখে জল দিয়ে শরীর ও মন সুস্থ হল। মনে তখন ভয় বা উদ্বেগ আদৌ নেই। সুতরাং ধীর মস্তিষ্ক নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে সেই সুঁড়িপথটা প্রায় আধঘণ্টা পরে বার করলাম।
কুলামাড়ৌ যখন এসে পৌঁছেচি তখন রাত বারোটার কম নয়। গ্রাম নিষুতি হয়ে গেছে বহুক্ষণ; আমায় দেখে গ্রাম্য কুকুরের দল মহা ঘেউ ঘেউ শুরু করলে। একটা ঘরের দাওয়ায় লোকেরা, শুয়েছিল, কুকুরের ডাক শুনে তারা জাগলো। আমায় দেখে তারা খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমায় বনের মধ্যে যেতে দেখেছিল দুপুরের পরে বললে, “খুব বেঁচে গিয়েছিস বাবু। শঙ্খচূড় সাপের সামনে পড়লে আর বাঁচতিস না। ধঝরির বনে বড্ড শঙ্খচূড় সাপের ভয়।”
রাতটা সে গ্রামে কাটিয়ে সকালের দিকে সুবর্ণরেখা পার হয়ে গালুডিতে ফিরে এলাম।
Leave a Reply