হারুন উর রশীদ স্বপন
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের ভুয়া মামলা, প্রতিকার, মানবাধিকার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সিনিয়র আইনজীবী ও মনবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্না।
ডয়চে ভেলে: আপনি নিজেও তো একটি মিথ্যা মামলার শিকার৷ ৫ আগস্টের পর থেকে মিথ্যা মামলা ছড়াছড়ি কেন?
জেড আই খান পান্না: মিথ্যা মামলার কারণ তো আমি বলতে পারবো না, এটা বলতে পারবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর আইন মন্ত্রণালয়। সব মামলায়ই দেখবেন এক জন মারা গেছে বা গুলি খেয়েছে, কমপক্ষে দুই’শ আসামি। ছয়শ’ও আছে। একই স্ক্রিপ্ট। ব্যারিস্টার সারা হোসেন যথার্থই বলেছেন, একটা স্ক্রিপ্ট হয়তো সব জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটাই হয়তো ব্যবহার করছে।
সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীকেও হত্যা মামলায় আসামি করা হচ্ছে। যদি একই স্ক্রিপ্ট হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
কেন জড়ানো হচেছ সেটা বলতে পারবে বর্তমান সরকার। তার ইন্টারেস্টে যখন লাগে, তখনই তাকে জড়ানো হয়। এছাড়া অন্যকিছু না।
মেরিট দেখবে না? কেউ থানায় গেলেই মামলা নিতে হবে– এরকম কোনো বিষয় আছে নাকি?
বোধ হয় আছে। তা না হলে তো থানা চেক করে মামলা নিতো। বোধ হয় ইনস্ট্রাকশন আছে যে, নিয়ে নাও।
কিন্তু নিয়মটা কী? থানা তো মামলা নেয়ার আগে মিনিমাম চেক করবে।
হ্যাঁ, চেক করবে। দেখবে মেরিট আছে কিনা, প্রাইমাফেসি আছে কিনা। প্রাথমিক সত্যতা নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ হলে মামলা নিবে না। ক্রিমিনাল কেস না নিয়েও উপায় নাই। অনেক সময় থানা নিতে বাধ্য হয়।
সরকার এখন বলছে ,যারা দায়ী নয়, তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দেয়া হবে। যারা ভুয়া মামলা করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এতে কি কাজ হবে? অনেক মামলা তো হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, মামলা তো অনেক হয়ে গেছে। তবে একজন অ্যাকিউজড হিসাবে বলছি যে, এইটুকু লাভ হবে যে, আমি কোট করতে পারবো। আমি বলতে পারবো যে, এটা আইন উপদেষ্টা বলেছেন- মিথ্যা মামলা হলে সেটা গ্রহণ না করতে।
এখানে তো অনেক অজ্ঞাত পরিচয় আসামি আছে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামির বিষয়টি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে? অপব্যবহারের আশঙ্কা আছে?
প্রতি মামলায়ই কমপক্ষে দুইশ’-তিনশ’ অজ্ঞাত আসামি আছে। অপব্যবহারের আশঙ্কা অবশ্যই আছে। আপনার মামলায় নাম নেই, কিন্তু ৫৪ ধারায় ধরে ওই মামলায় ইনভলব করে দিলো অজ্ঞাতদের মধ্যে।
এটা কি পুলিশকে অবৈধ কাজের সুবিধা করে দিলো?
অবৈধ কাজের সুবিধা করে দিলো । আবার একটা অর্থকরী ব্যাপার আছে। সেটা উপার্জনেরও একটা ব্যবস্থা করে দিলো।
স্বামী মারা যাননি, কিন্তু স্ত্রী হত্যা মামলা করে অনেককে আসামি করে দিলো। আবার ঘটনা যেখানে , সেখানে যাকে আসামি করা হয়েছে, তিনি ছিলেনই না। এরকম মামলা কেন করা হয়?
এটা আসলে হয়রানির জন্য করা হয়। আমার বিরুদ্ধে যে মামলা, তা যদি শেষ পর্যন্ত থাকতো, তাহলে আমি তো আদালতে প্রটেষ্ট করতাম। এই মামলা কি আদালতে টিকতো? এটা তো টেকার কথা নয়। মিথ্যা মামলা তো সাধারণত: আদালতে টেকে না।
আপনি বলেছেন, সরকারের স্বার্থে আঘাত লাগলে এই ধরনের মামলা হয়। এটা কি শুধু সরকার, না অন্য রাজনৈতিক বা স্বার্থবাদী গ্রুপও আছে?
সরকারই জড়িত। সরকারের সাথে অন্য যারা রাজনৈতিক দল আছে, মেইনলি জামায়াত, তারা জড়িত থাকতে পারে। হিযবুত তাহরির জড়িত থাকতে পারে।
মিথ্যা মামলার ব্যাপারে কি কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়? আদালতে মামলা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়? আইন কী বলে?
মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হলে, যিনি অভিযোগকারী তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
মিথ্যা মামলা করার দায়ে শাস্তির কোনো উদাহরণ আছে?
না, নাই।
তাহলে এই যে অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হলো, শেষ পর্যন্ত এর ফল কী হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার চলে গেলে এই মামলাগুলো থাকবে না। কিছু হয়তো থাকবে- যেগুলো জেনুইন।
তাহলে এই যে অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ, পুলিশ সংস্কারের কথা বলছে?
এগুলো বাত কা বাত। কিসের সংস্কার করবে? তাদের সংস্কার করার ম্যান্ডেট কে দিয়েছে? ছাত্ররা? ইউনূস সাহেবকে তো ছাত্ররা বসিয়েছে, উনিই এসে বলেছেন। ছাত্ররা কি এই দায়িত্ব দিয়েছে? ছাত্রদের একার দেশ? ছাত্র বাদেও কৃষক, শ্রমিক, মজুর অন্যান্য পেশার লোকাও তো আছে।
আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা। এখনো দেখছি। তাহলে কী পার্থক্য?
আমি পার্থক্য একটা দেখি। আগে একটা সরকার ছিল, সেই সরকারের সময় এখনকার চেয়ে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। এখন ইনকামও কম, কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
আর আইনের শাসন, পুলিশ প্রশাসন, এইসব ব্যাপারে…?
আইনের শাসন তো নাই। আগের সরকারের সময় বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব সেটা ছিলো অপ্রকাশ্য, গোপনে। সেটা এখন হচ্ছে প্রকাশ্যে। মব ভায়োলেন্সের দ্বারা সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়। পদত্যাগ করালো। কতগুলো বিচারপতি আওয়ামী লীগের আমলে অ্যাপয়নমেন্ট বলে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। কে যে করাচ্ছে! এগুলো তো ছাত্ররা করছে। সরকার কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিয়েছে? তাদের মদদেই এগুলো হচ্ছে।
পুলিশ , র্যাব বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কতটা স্বাধীন?
মোটেই না। বিন্দুমাত্র না। আপনারা তো সাংবাদিক- পুলিশ কতজন মারা গেছে একটু খোঁজ নেন। বলতে পারবেন কত জন পুলিশ মারা গেছেন? মারা গেছে এটা তো আপনি স্বীকার করবেন। কিন্তু তাদের বেলায় কি বিচার হবে না? তাদের কি বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? ছাত্রদের যেমন অধিকার আছে, অন্য মানুষেরও তো অধিকার আছে। পাঁচ তারিখের আগে যেমন আছে- পরেও আছে। তাদের তো বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।
মানবাধিকর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখেন ?
বিন্দুমাত্র না। বিন্দুমাত্র না। পুলিশের অ্যাক্টিভিটি, র্যাবের অ্যাক্টিভিটি তেমন নেই। চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। হাত বদল হয়েছে। ছিনতাই বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে।
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply