কবিতা রচনা
আমার যতদূর মনে পড়ে, আমাদের শহরের ঈশান স্কুলে ক্ষীরোদবাবু নামে একজন পণ্ডিত মহাশয় আসিলেন। শুনিতে পাইলাম তিনি একজন কবি এবং আমাদের পাঠ্যবইতে যেসব কবিতা আছে তেমনি কবিতা তিনি রচনা করিতে পারেন। আরও খবর পাইলাম, তিনি আমাদের স্কুলের দ্বিতীয় পণ্ডিত শ্রদ্ধেয় বাবু যোগেন্দ্রনাথ সেনের বাড়িতে থাকেন। শুনিয়া বড়ই আশ্চর্য হইলাম। যে-লোক কবিতা লিখিতে পারেন, কেমন তিনি দেখিতে, কেমন তাঁহার চাল-চলন, জানিবার কৌতূহল আমার বালকমনকে বারবার দোলা দিতে লাগিল। একদিন সত্যসত্যই তাঁহার নিকট যাইয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে খুবই স্নেহের সঙ্গে গ্রহণ করিলেন। তাঁহার রচিত কয়েকটি কবিতাও পড়িয়া শুনাইলেন। তাঁহার সুন্দর ব্যবহারে আমার মন তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইল বটে কিন্তু কবি বলিতে আমি যে একজন কিম্ভুতকিমাকার লোককে মনে মনে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিলাম তাহা যখন ভাঙিয়া চুরমার হইল তখন বেশ নিরাশ হইয়া পড়িলাম।
ইহার পরে বাড়ি আসিয়া আমার পিতার ছোটবেলার একখানা পাঠ্যবই খুঁজিয়া পাইলাম। সেই বই-এর অর্ধেক উইএ কাটিয়া ফেলিয়াছে। সেখান হইতে ঈশ্বর-বিষয়ক একটি কবিতার সামান্য কিছু অদলবদল করিয়া নিচের লাইন উপরে দিয়া উপরের লাইন নিচে দিয়া আমার খাতায় টুকিয়া লইলাম। সেটি বন্ধুদের দেখাইলে তাহারা পড়িয়া অবাক হইল। তাহাদের সমবয়সী আমি যে সত্য সত্য একটি কবিতা লিখিতে পারিয়াছি জানিয়া তাহারা আমার শত শত প্রশংসা করিতে লাগিল। সেই কবিতার দু’টি লাইন এখনও আমার মনে আছে।
তুমি ভীম-ভবার্ণবে ভাসিবার ভেলা,
তোমাকে প্রণাম কালে করি অবহেলা।
ইহার পর আমার পিতার সেই পুরাতন পাঠ্যপুস্তক হইতে আর কবিতা টুকিয়া লওয়া যায় না। আর সব কবিতার ভাষা কঠিন। কেহ অর্থ জিজ্ঞাসা করিলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা! মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, কি করিয়া নতুন কবিতা রচনা করা যায়? প্রথম বারের রচিত কবিতাটি বন্ধুদের নিকট পড়িয়া পড়িয়া পুরান করিয়া ফেলিয়াছি। নতুন কবিতা না হইলে আর তাহাদিগকে আশ্চর্য করা যায় না।
শুনিয়াছিলাম, কবিতার প্রত্যেক লাইনে চৌদ্দটি অক্ষর থাকিবে আর প্রত্যেক লাইনের শেষ অক্ষরের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের শেষ অক্ষরের মিল থাকিবে। কাগজ-কম লইয়া ভাবিতে ভাবিতে থামিয়া যাই, নদীর ধারে বসিয়া ওপারের চরের দিকে চাহিয়া থাকি কিন্তু কিছুতেই চৌদ্দ অক্ষরের লাইন মিলাইতে পারি না। মাঝে মাঝে রাগ করিয়া মাথার চুল ছিঁড়ি।
একদিন হঠাৎ আমার মনে হইল, আমি যে উপস্থিতভাবে কবিগানের বোল রচনা করিতে পারি তাহা খাতায় লিখিলে কেমন হয়? তিন-চার জোড়া বোল খাতায় লিখিয়া আশ্চর্য হইলাম। তাহার প্রত্যেক লাইনে চৌদ্দ অক্ষর, আর প্রত্যেক লাইনের শেষ অক্ষরের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের শেষ অক্ষরের মিল আছে। এই আবিষ্কারে আমার মনে যে আনন্দ হইল, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াও সেই আনন্দ পাইয়াছিলেন কি না মনে সন্দেহ জাগে।
চলবে…
Leave a Reply