কবিতা রচনা
এতদিন আমি সুরের সঙ্গে পদ রচনা করিতে অভ্যস্ত হইয়াছিলাম। সুর না করিয়া শুধু কথার ছন্দে পদ রচনা করিতে পারিতাম না। আজ যখন সুরের সঙ্গে রচিত পদ, কথার ছন্দে রচিত পদের সঙ্গে এক বলিয়া আবিষ্কার করিলাম তখন আর আমাকে পায় কে! খাতার পর খাতা লিখিয়া চলিলাম। প্রায় অধিকাংশ কবিতার বিষয়বস্তু ছিল সংসারের অনিত্যতা-বিষয়ক। তখনকার বয়সে বড়দের আলাপ-আলোচনায় যাহা যাহা শুনিতাম, তাহাই আমার কবিতার বিষয়বস্তুতে পরিণত করিতাম। ক্ষীরোদবাবু আমার কবিতাগুলি পড়িয়া খুব তারিফ করিতেন। কিন্তু যাহাদের তারিফের জন্য এত সাধ্য-সাধনা করিয়া কবিতা লিখিতাম সেই বন্ধুমহলের অনেকেই মন্তব্য করিত, “এ কবিতা কিছুতেই তোমার রচনা নয়। তুমি হয়তো কোথা হইতে টুকিয়া আনিয়াছ।” কিন্তু কি করিয়া আমি প্রমাণ করিব এই কবিতা আমি টুকিয়া আনি নাই, নিজে রচনা করিয়াছি। একান্তে বসিলে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হইত।
বন্ধুদের এই সন্দেহের কথা ক্ষীরোদবাবুকে বলিলে তিনি সস্নেহে আমাকে বলিলেন, “তোমার বন্ধুরা যে বলে তুমি অপরের রচনা নকল করিয়া তাহাদের দেখাইতেছ, ইহাতেই তো তাহারা তোমাকে কবি বলিয়া স্বীকৃতি দিয়াছে। পরোক্ষে তাহারা বলিয়াছে তুমি অপর কবিদের মতো লিখিতে পার।” কিন্তু ইহাতে কি আমার মন সান্ত্বনা মানে?
তখনকার দিনে একটি কবিতার কথা মনে আছে। ইহার সাত লাইনের স্তবকের পরে
এই লাইনটি যুক্ত ছিল-
মাকাল উহার নাম ভিতরে গরল।
ইহার পর ক্লাসের সাময়িক ঘটনা অবলম্বন করিয়া কবিতা লিখিয়া বন্ধুদের মধ্যে আমি সত্যকার কবি বলিয়া স্বীকৃতি আদায় করিয়াছিলাম।
আমার কবি-জীবনে ক্ষীরোদবাবুই আমার দ্বিতীয় কবি-গুরু। প্রথম কবি-গুরুর কথা পরে বলিব। ক্ষীরোদবাবুর সঙ্গে প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় আমি নদীর ধারে বেড়াইতে যাইতাম। দুইজনে আসন করিয়া বসিয়া ডুবন্ত বেলার দিকে চাহিয়া থাকিতাম। তিনি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ধরনে কবিতা লিখিতেন। তাঁহার কবিতাগুলির অধিকাংশই সংসারের অনিত্যতা বিষয়ক ছিল। ফিরিবার পথে কবিতা রচনার বিষয়ে তিনি আমাকে নানা উপদেশ দিতেন।
আলপনার নকশা আঁকার মতো উপস্থিত ছড়া কাটিয়া বোল রচনায় একটি অপূর্ব আনন্দ আছে। এই রচনা কাগজের পৃষ্ঠায় লেখা থাকে না বটে কিন্তু রচকের মনে আর শ্রোতাদের মনে উপস্থিত বোল যে আনন্দধারা বহিয়া আনে তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া লেখা কাগজের রচনার চাইতে কোনো অংশেই কম বলিয়া আমার মনে হয় না। বরঞ্চ উপস্থিত রচনার কোনো কোনো অংশ কাগজের রচনার চাইতেও ভালো হয়। কারণ উহার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা থাকে না। রচক যেমনটি অনুভব করিলেন তাহাই তৎক্ষণাৎ শ্রোতাদের মধ্যে বিলাইয়া দিলেন। তাঁহার অনুভূতির উষ্ণতা শ্রোতারা সহজেই অন্তরে ধারণ করিতে পারে। কাগজে-কলমে
লিখিতে গেলে ভাবের উষ্ণতা অনেকখানি জুড়াইয়া যায়।
আলপনার মতো কবিগান রচনা বাংলা কবিতার প্রকাশভঙ্গির একটি দিক। এই পথে কিছুটা তপস্যা করিলে আমাদের তরুণ কবিরা উপকৃত হইবেন বলিয়াই আমি মনে করি।
আমার নিজের রচনায় তেমন চাতুর্যভরা মিল বা অনুপ্রাসের বর্ণচ্ছটা নাই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হইতে আরম্ভ করিয়া আরও অনেক সমালোচক বলিয়াছেন, “আমার ছন্দের গতি খুব সহজ।”
ইহা যদি আমার গুণ হইয়া থাকে তবে এই শিক্ষা আমি পাইয়াছি আমার দেশের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কবিয়ালদের কাছে। তাহারাই আমার কাব্য-জীবনের প্রথম-গুরু। সেই যাদব, পরীক্ষিত, ইসমাইল, হরি পাটনী, হরি আচার্য এঁদের কথা আমি যখন ভাবি আমার অন্তর কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হইয়া ওঠে। পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে তাঁহারা যে অমৃতধারা বিতরণ করিতেন তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া আজ বাঙালির অন্তর শুষ্ক মরুভূমি হইয়া পড়িতেছে।
চলবে…
Leave a Reply