চৈত্র-পুজা
এই চৈত্র-পূজায় সুদর্শন ছেলেরা মেয়ে সাজিয়া নাচিয়া যেসব অষ্ট-গান গাহিত তাহার তুলনা কোথাও মেলে না।
একটি গানের পদ আজও আমার মনে আছে:
ও সুখ বসন্ত কালে ডালে বসে কালো কোকিল তুমি ডেকনারে আর।
অথবা-
বাইদ্যা আইল বাড়িতে ও দিদি শাশুড়ি, আমায় কিনা দাও চুড়ি চাইর আনার পয়সা হইলে কিনি বেলোয়ারি চুড়ি।
এই অষ্ট-গানের সুর অন্যান্য পল্লীগানের সুর হইতে একেবারে আলাদা। আমার ‘বেদের মেয়ে’ নাটকে “ও বাবু! সেলাম বারে বার” গানটিতে আমি একটি অষ্ট-গানের সুর ব্যবহার করিয়াছি। আমাদের গ্রামের শিল্পী ছাড়াও চৈত্র-পূজায় মাঝে মাঝে পদ্মার-পার (ঢাকা জেলা) হইতে কালী-নাচের দল আসিত। নানা দেবদেবীর মুখোশ পরিয়া তাহারা অপূর্ব নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করিত। কালীর মুখা নাচান এই দলের একটি বিশেষ অভিনয়দক্ষতার পরিচয় ছিল। একটি লোক যখন কালীর মুখোশ পরিয়া এক হাতে খাঁড়া অপর হাতে মানুষের মাথা লইয়া আসরে প্রবেশ করিত তখন দর্শকদের মধ্যে একটা ত্রাসের সঞ্চার হইত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে চিৎকার করিয়া উঠিত। কালী আসিয়া আসরে দাঁড়াইলে বালা দুই হাতে দুইটি ধূপতি লইয়া কালীর মুখের সামনে ঘুরাইত। তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকি ঢাক বাজাইত। তাহার তালে তালে কালী ধীরে ধীরে কাঁপিয়া উঠিত। তারপর হাত কাঁপাইয়া, ঘাড় এদিক-ওদিক ঘুরাইয়া আস্তে আস্তে নাচ আরম্ভ করিত। সেই নাচ ধীরে ধীরে ভীষণ হইতে ভীষণতর হইতে থাকিত। তখন হিন্দু মেয়েরা জোকার দিয়া উঠিত। কালী নাচিতে নাচিতে কখনও নিজের হাতের খাঁড়া দিয়া নিজের বক্ষ নিজে বিদীর্ণ করিতে চাহিত। তারপর কি মনে করিয়া কাঁদিত। তখন ঢাকের বাদ্য অন্যরকমের বাজিত। ইহার পর কালী রুষ্ট হইয়া তাহার খাঁড়া লইয়া আসরের চারিদিকে ঘুরিয়া কাকে যেন আক্রমণ করিতে ছুটাছুটি করিত। তখন ঢোলের বাদ্য ভীষণ হইতে ভীষণতর হইত। মেয়েরা আবার উলুধ্বনি করিত। কালী তখন অন্যরকমে পা ফেলিয়া রুদ্র-নাচন নাচিত। নাচিতে নাচিতে কালীবেশধারী নর্তক অজ্ঞান হইয়া পড়িত।
আজ পরিণত বয়সে এই নাচের কথা ভাবিতে মনে হয়, ভয়কে যেমন মানুষ এড়াইয়া চলিতে চায়, ভয়কে তেমনি মানুষ উপভোগও করে। তাহা না হইলে নৃত্যকলার মধ্যে এই ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা করিয়া মানুষ আনন্দ পায় কেন?
চৈত্র-সংক্রান্তির শেষরাত্রে আমাদের গ্রাম-সংলগ্ন শ্মশানঘাটে হাজরা পূজা হইত। বাদ্যভাণ্ড বাজাইয়া শোভারামপুর হইতে একদল আর লক্ষ্মীপুর হইতে আর একদল হাজরা পূজা করিতে আসিত। আমাদের গ্রাম-সংলগ্ন শ্মশানঘাটে হাজরা পূজা করিতে শ্মশান-পূজার চিতা নির্বাচন লইয়া লক্ষ্মীপুরের দলের সঙ্গে শোভারামপুরের দলের প্রায়ই সংঘর্ষ হইত। এজন্য দুই দলের লোকই লাঠি-সোঁটা লইয়া প্রস্তুত হইয়া আসিত। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা মধ্যস্থ হইয়া তাহাদের এই কলহ মিটাইয়া দিত। এই হাজরা পুজা দেখিবার জন্য মিঞাভাই প্রতিবার শেষরাত্রে উঠিয়া শ্বাশান-ঘাটে যাইতেন। আমাকে সঙ্গে লইতেন না। সেবার অনেক বলিয়া কহিয়া মিঞাভাইকে রাজি করাইলাম। গভীর রাত্রে দূর হইতে যখন ঢাকের বাদ্য শুনিতে পাইলাম মিঞাভাই আমাকে ডাকিয়া উঠাইলেন। ঢাকের বাদ্যের তালে তালে ভয়ে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল। আমি মিঞাভাইয়ের হাত ধরিয়া চলিলাম।
চলবে…
Leave a Reply