শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০১ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮০)

  • Update Time : শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

চৈত্র-পুজা

ভয়ের কথা বলিলাম না। বলিলে হয়তো আমাকে সঙ্গে লইবেন না। আমাদের গ্রামের আরও অনেকে হাজরা পূজা দেখিবার জন্য শ্মশানঘাটের পথে চলিতেছিল। আমরা তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। এবার আমার বুকের দুরুদুরু ভাব কিছুটা কমিল। ধীরে ধীরে শোভারামপুরের দল শ্মশানঘাটের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঢাকের বাদ্য অতিক্রম করিয়া মাঝে মাঝে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করিয়া শব্দ আসিতেছিল, বলরে হরগৌরী নাম, বি-ভোর। সেই শব্দে আবার নূতন করিয়া আমার বুক দুরুদুরু করিতে লাগিল। প্রায় তিন-চার শ’ লোক লইয়া হাজরা পুজার দল শ্মশানঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই অনুষ্ঠানের পুরোহিত কোনো ব্রাহ্মণ নয়, বালা। এই বালারা মন্ত্র-তন্ত্রে বড়ই অভিজ্ঞ। ভালোমতো গুণ-গ্রাম না জানিলে অপরপক্ষের বালা আসিয়া মন্ত্র দিয়া এ-পক্ষের সন্ন্যাসীদিগকে উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারে। শোভারামপুরের বালা আমাদের গ্রামের মন্ত্রজ্ঞানী রামে-রাজ।

ইহার মতো গুনিন ব্যক্তি আমাদের তল্লাটে নাই। হাজরা পূজার পনরো দিন আগে হইতেই পাড়ার সাহসী এবং বলিষ্ঠ একদল যুবক সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করিয়া ভাঙরা নাচের দলে এ-গ্রামে ও-গ্রামে ঘুরিত। আজ তাহারা মালকোঁছা দিয়া কাপড় পরিয়া সারি বাঁধিয়া শ্মশানের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পিছনে পূজার সামগ্রী ও শোভারামপুরের অন্যান্য লোকজন। মূল বালা রামে-রাজ দুইটি ধূপদানি হাতে লইয়া সন্ন্যাসীদের মুখে ধূপের ধোঁয়া দিতে লাগিলেন। ঢাকের বাদ্য এখন কি গম্ভীর আওয়াজে অন্য তালে বাজিতেছে! সন্ন্যাসীরা সেই তালে তালে ধীরে ধীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দোলা দিতে লাগিল। বালা জোরে জোরে মন্ত্র আওড়াইতে লাগিল। তারপর সেই ঢোলের তালে তালে সন্ন্যাসীরা নাচিতে আরম্ভ করিল। সে কি ভীষণ উন্মাদনাভরা নাচ!

এমন ভয়ঙ্কর নাচ জীবনে কোথাও দেখি নাই। উদয়শঙ্করের তাণ্ডব নাচ দেখিয়াছি। তাহাতে হয়তো অনেক শিল্পকার্য আছে কিন্তু এমন পরিবেশ নাই। শ্মশানের আলোতে চারিদিকের অন্ধকার আরও জমাট ধরিয়াছে। তাহারই মাঝখানে অর্ধ-উলঙ্গ এই সন্ন্যাসীদের নৃত্য। আর মাঝে মাঝে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি উঠিতেছে, বলরে হরগৌরী নাম:

বি-ভো-র

তারপর কি একটা মন্ত্র পড়া শেষ হইলে সন্ন্যাসীদল এখান হইতে রাত্রের গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হইয়া গেল। জয়ঢাকের তালে তালে তাহাদের হাতের জোড়া-বেতের লাঠি মাটির উপর পড়িতেছে, সপাং সপাং সপাং।

শ্মশানঘাটে একটি পুরাতন শেওড়া গাছ ছিল। বহু বছরের লতায় পাতায় ও কাঁটাগাছে জড়াইয়া তাহার তলদেশটি লোকজনের অনতিক্রম্য ছিল। তাহারই এক পাশে একটি জায়গা আগে হইতেই পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছিল। সেখানেই হাজরা পূজা হইবে। সেই গাছের তলায় পাতা বিছাইয়া ছোট ছোট পাত্রে তেল, সিন্দুর, চন্দন, রক্তজবা, ধুতরার ফুল ও পূজার ভোগ ইত্যাদি রাখিয়া রামে-রাজ তাহার পিছনে বসিয়া জোরে জোরে ডাক ছাড়িয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। ঢাকের বাদ্য এখন খুব ধীরে ধীরে হইতেছে। সন্ন্যাসীরা সপাসপ বেতের আঘাত করিয়া শেওড়া গাছের চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতেছে। বাহিরের হিন্দু জনতা রহিয়া রহিয়া ধ্বনি দিতেছে।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024