বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:১০ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮৫)

  • Update Time : বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

থিয়েটার

পরলোকগত কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদারের সময় হইতে আমাদের ফরিদপুর শহরে প্রতি বছর একটি কৃষি-শিল্প প্রদর্শনী বসিত। এই উপলক্ষে সেখানে নানারকম গান-বাজনা হইত। একবার সেখানে বিশ্ব-মঙ্গল অভিনয় দেখিয়া আসিলাম। এই আমার প্রথম থিয়েটার দেখা।

পরদিন বিকালে নদীর ধারে কাপড় টানাইয়া কৃত্রিম মঞ্চ তৈরি করিয়া পাড়ার ছেলেদের ডাকিয়া বিদ্বমঙ্গল ঠাকুরের অভিনয় দেখাইলাম।

চিন্তা ধ্যান চিন্তা জান চিন্তামণি কোথা গেলে তুমি?

বলিয়া আমি যখন অভিনয় করিতেছিলাম, আমার শ্রোতারা সেদিন সত্যকার থিয়েটারের শ্রোতাদের চাইতে আমার কম তারিফ করে নাই।

ইহার পরে বড় হইয়া থিয়েটার দেখার নেশা আমাকে পাইয়া বসিল। ফরিদপুর টাউন-থিয়েটারের অভিনয় হইত টিকেট করিয়া। কিন্তু টিকেট কেনার পয়সা আমি কোথায় পাইব। অভিনয়-ঘরের জানালার পাশে একটি সুপারি গাছ ছিল। সেই সুপারি গাছে উঠিয়া শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে অভিনয় দেখিতাম। শাজাহান, মোগল-পাঠান, সোনায়-সোহাগা, রাজা হরিশচন্দ্র প্রভৃতি নাটকের অভিনয় আমি এইভাবে দেখিয়াছিলাম। মাঝে মাঝে চাহিয়া-চিন্তিয়া দু’একদিন পাস সংগ্রহ করিতাম। সেদিন অভিনয়ের সমস্ত কিছু মনে মনে মুখস্থ করিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতাম। পরদিন নদী-তীরে যাইয়া অভিনয়ের চরিত্রগুলির মতো বক্তৃতা করিতাম।

ফরিদপুরে ড্রামেটিক ক্লাব নামে আরও একটি থিয়েটারের দল ছিল। এই দলে নায়কের পাঠ করিতেন বাবু বিমলচন্দ্র সেন। একবার স্কুলের রিসাইটেশনের কোনো পাঠ লইয়া কিছু নির্দেশ পাইতে আমি বিমলবাবুর কাছে গেলাম। তিনি সস্নেহে আমার পাঠটি আমাকে শিখাইয়া দিলেন। সেই হইতে তাঁহার সহিত আমার খুব ভাব হইয়া গেল। থিয়েটারে প্রায়ই তিনি আদর্শ চরিত্রের অভিনয় করিতেন। আমার মনে হইত তিনি যেন সেইসব চরিত্রের সমস্ত সদ্গুণেরই অধিকারী। তাই তিনি আমার বালক-বয়সের কল্পনায় একটি ছোটখাটো দেবতা ছিলেন। একবার থিয়েটারের বড় বড় বক্তৃতার অনুকরণে কল্পিত কোনো কাহিনীর পাঠ খাতা ভরিয়া লিখিয়া তাঁহার নামে উৎসর্গ করিয়া তাঁহাকে পড়িতে দিলাম। তিনি পড়িয়া বলিলেন, “বেশ মিষ্টি লাগিতেছে।” মাতৃ-দুগ্ধের মতো এরূপ স্বীকৃতি নূতন সাহিত্যিকদের পক্ষে বড়ই উপকারী। তখনকার লেখায় কত যে ভুল-ত্রুটি আর উচ্ছ্বাস থাকিত। কিন্তু কোনোদিনের জন্যও তিনি আমার লেখার সমালোচনা করেন নাই। তিনি শুধু প্রশংসাই করিতেন।

বিমলবাবু ভালো অভিনেতা ছিলেন। তাঁহার মতো এমন মিষ্টি কন্ঠস্বর খুব কম লোকেরই দেখিয়াছি। রাজা হরিশচন্দ্রের পাঠ বলিয়া তিনি তাঁহার দর্শকদিগকে কাঁদাইয়া আকুল করিতেন। তখনকার দিনে মফঃস্বলের রঙ্গমঞ্চগুলিতে অমরেন্দ্রনাথের যুগ চলিতেছে, থিয়েটারে মুক-অভিনয়ের দিন তখনও আসে নাই।

তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় আমি ড্রামেটিক ক্লাবের রিহার্সেলে প্রবেশ করিবার সুযোগ পাইলাম। আমার বয়সী যে দু’চারজন অল্পবয়সের বালক থিয়েটারে পাঠ ও নৃত্য-গীতের সুযোগ গাইত, আমি তাহাদিগকে ভাগ্যবান মনে করিতাম। থিয়েটারের রিহার্সেল বারবার দেখিয়া কোনো কোনো পাঠের অংশ আমার মুখস্থ হইয়া যাইত। সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধারে দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে তাহারই অনুকরণ করিতাম। লোকে আমাকে পাগলা জসীম বলিত। এইভাবে একা একা অভিনয় করিয়া কণ্ঠস্বরের আড়ষ্টতা অনেকখানি সাবলীল হইল। নিজের স্বরকে নানা ভঙ্গিতে নামানো উঠানোর শিক্ষা আমি লাভ করিলাম।

চলবে…

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024