নারীরা কোথায় গেলো?
নিজস্ব প্রতিবেদক
“নারীরা কোথায় গেলো?” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে লড়াকু-২৪ এবং Empowering our Fighters ২২শে নভেম্বর ২০২৪ তারিখ বিকেল ৩টায় ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে গণঅভ্যুত্থানে নারীদের সংলাপের আয়োজন করে ।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের সর্বস্তরের নারীদের অভূতপূর্ব উপস্থিতি ছিলো। নারীরা এ সময় যেমন রাজপথের লড়াইয়ে সক্রিয় থেকেছেন, তেমনি সোচ্চার থেকেছেন অনলাইনে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা যেমন এ আন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি শিক্ষার্থী-জনতার দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঘরে-বাইরে-প্রবাসে নারীরা প্রকাশ্য রাজপথে ও অনলাইনে সোচ্চার থেকেছেন। অন্যদিকে, সন্তানের পাশে মায়েরা রাজপথে যেমন স্লোগানে-মিছিলে থেকেছেন, তেমনি কোনো কোনো নারী আবার খাবার, আশ্রয়, চিকিৎসা, সাহস, অর্থ সাহায্য দিয়ে পাশে থেকেছেন। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশে ধনী থেকে দরিদ্র, নানান ধর্মের, নানান জাতিসত্ত্বার, সর্বস্তরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, পরিচয়ের নারীরা গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সমাজের অন্য সবার মতোই নারীদের এই সাহসী, নির্ভীক ভূমিকা ছাড়া ১৬ বছরের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিলো না। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও নারীরা প্রকাশ্যে এবং নিভৃতে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
আমরা যারা গণঅভ্যুত্থানে আহতদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি, তারা মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ্য করেছি এই স্বেচ্ছাসেবকদের অধিকাংশই নারী। এমনকি দেশ ও বিদেশ থেকে যারা আহতদের সহায়তায় অর্থ সাহায্য পাঠাচ্ছেন, তাদেরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী।
অথচ, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে অসীম সাহসিকতার ভূমিকা রাখা সর্বস্তরের নারীদের প্রতিনিধিত্ব আমরা রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছি না। যেন তারা হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে গেছেন। গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিলো, বৈষম্যমুক্ত সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি নারীদের বাদ দিয়ে যা কখনোই সম্ভব না। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র যদি একটি বিশেষ লিঙ্গের, বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ জাতি-ধর্ম পরিচয়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে ওঠে, তবে তা হবে শহীদ ও আহতদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী।
ফলে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ হতে না দেওয়ার দায়বোধ থেকে আমরা দুটি স্বেচ্ছাসেবক দল- লড়াকু ২৪ এবং Empowering our Fighters গণঅভ্যুত্থানের নারীদের এই সংলাপ আয়োজন করেছি। নানান পর্যায়ের নারীদের গণঅভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান পরবর্তী অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজেদের নায্য হিস্যা বুঝে নেওয়ার সংকল্প থেকেই মূলত এই আয়োজন। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা না গেলে জনগণের বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের অনান্য আন্দোলনের মতো আবারও বেহাত হয়ে যাবে।
বক্তাদের বক্তব্যঃ
শামিমা সুলাতানা লাবু, আহত নারী সাংবাদিক, সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল ২৪, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে তার পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে কাজ করতে গিয়ে তিনি আহত হন এবং হামলার শিকার হন । চ্যানেল ২৪ আন্দোলনের পক্ষে সংবাদ প্রচার করায় গত স্বৈরাচার সরকারের চাপে ২০ মিনিট সম্প্রচার বন্ধ রাখতে হয়েছিলো । এমনকি তাঁরা কি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবেন, অনুষ্ঠানে কে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এবং স্ক্রিপ্টে কি লিখা হবে তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল এবং তাঁরা টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে গিয়ে অবিস্থানও করছিলেন । তিনি তার ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোনে ধারণ করা অনেক ফুটেজ তিনি তার চ্যানেলে সম্প্রচার করতে পারেননি, তখন তিনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গণমাধ্যমের সাথে শেয়ার করেন, বিশেষ করে ইউএন লেখা হেলিকপ্টার এর ফুটেজ এবং আন্দোলনের নানান ফুটেজ । এখন আন্দোলনের পর নারীদেরকে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না ।
উমামা ফাতেমা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, আন্দোলনে অংশগ্রহণ আমার কাছে উৎসবের মত ছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আন্দোলনে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি কিন্তু ৫ই আগস্ট সময়ের পর থেকে আমিসহ অন্যান্য নারী আন্দোলনকারীরা অনুভব করি আমরা আসলে গুরুত্বহীন, আমাদেরকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না যেভাবে এবং যতটা পুরুষ আন্দোলনকারী-সমন্বয়কদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে । এখন খুব বেশি নারী সমন্বয়কদের এবং আন্দোলনকারীদের সাইডলাইন করা হয়েছে, কর্নার করা হয়েছে । এখন প্রচণ্ড আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পরেছি এবং মনেহচ্ছে আমি বা আমরা কিছুই করিনি । সর্বোপরি, নারীদেরকে পর্যাপ্তভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি নানান পদে বসিয়েও খুব একটা কাজ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না ।
সামিয়া আক্তার জান্নাত, শিক্ষার্থী, কামরাঙ্গির চর হাই স্কুল, তিনি চানখার পুলের অগ্নিকন্যা হিসেবেও অনেকে তাকে চেনে । অনেকে তাকে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন । বাড়িতে বাবা-মাকে মিথ্যা বলে তিনি আন্দলনে যুক্ত হন । তিনি ভিসি চত্তরের ওখানে আক্রমণের শিকার হন, পুলিশ তার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের নখ টেনে উঠিয়ে ফেলেছে এবং তার মাথার পিছনে সজোরে আঘাত করে, ফোলে তার চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে তার মাথার চুল কেটে ফেলতে হয়েছে । তার বাবাকে অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি দেশে ফিরতে না পারেন এবং ফিরলে তাকে জেলে যেতে হবে কারণ তিনি বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও দিয়েছিলেন। এত হুমকি সামিয়াকে থামাতে পারেনি। আমরা নারীরা প্রয়োজন পরলে আবারও রাস্তায় বুক পেতে দাঁড়াব ।
সামিনা ইয়াসমিন, শ্রমিক গার্মেন্টস নারী, আশুলিয়া, প্রথেমের দিকে আমরা আন্দোলনে যুক্ত হতে পারিনি। বেক্সিমকো তে যেহেতু কাজ করছি এস আলমের গ্রুপ কাজ করছি, এই বড় কারখানায় কাজ করে আমাদের জন্য আন্দোলনে কাজ করা খুব একটা সহজ ছিল না, চাকরি হারানোর ভয় ছিল । যখন দেখি শিক্ষার্থী ভাইয়েরা মার খাচ্ছে, তখন আর ঘরে থাকা যায় না । তখন কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিলেমা প্রতিবাদ স্বরূপ এবং পরবর্তী সময়ে অনেক শ্রমিক আন্দোলনে ছিলেন, শুধু আশুলিয়াতেই ২৭ জন শহীদ হয়েছেন । শ্রমিকদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের সংস্কার এবং উন্নতি হবে না । তাই শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের পরিকল্পনার রাখতে হবে বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের ।
ফারজানা সুলতানা নীলা, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, যখন দেখলিমা যে শিক্ষার্থীরা আহত হচ্ছে তখন মনে হচ্ছিল যে আমরা কিভাবে কাজ করতে পারি । তখন আমরা ৩০-৩৫ জন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী মিলে কাজ শুরু করি । কিভাবে আমাদের সেবা গুলো হাসপাতালে আহত রোগীদের কাছে পৌঁছাতে পারি সেঁতা নিয়ে আমরা ভাবতে থাকি এবং লড়াকু-২৪ এর সাথে যুক্ত হই এবং ঐ আহত রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন । এবং এমনকি যারা আহতদের জন্য কাজ করছেন তাদেরকেও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছেন ।
দিল আফরোজ, আন্দলনে আহত এবং দৃকে কর্মরত, ২০২৪ এর ১৭ই জুলাই গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বিকেল ৩;১০ মিনিটে সাউন্ড গ্রেনেড তাকে লক্ষ্য করে মারা হয় এবং তাকে তাৎক্ষনিক ভাবে হাসপাতালে কোন রকমে চিকিৎসা নিয়েছেন বাড়ি চলে যান এবং তার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে পরে এবং তিনি খুবই ভয় পান মনে হয় যেকোনো সময় তিনি গ্রেফতার হয়তে পারেন । সে ভীতি থাকা স্বত্বেও তিনি পিছপা হননি ।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, রেহনুমা আহমেদ, নৃবিজ্ঞানী ও লেখক, শিরিন হক, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, প্রফেসর, নৃবিজ্ঞানী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সীমা দত্ত, রেবেকা নীলা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সমগিত ।
পরিশেষে, বক্তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর নারীদেরকে যেভাবে সাইডলাইন করা হচ্ছে, অবহেলা করা হচ্ছে এবং স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে না সেটি আশংকার এবং গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সাথে সাংঘরশিক । তাই রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিকল্পনায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
Leave a Reply