শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ পূর্বাহ্ন

টলস্টয়ের স্মৃতি (পর্ব-০১)

  • Update Time : শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৬.২১ পিএম

ম্যাকসিম গোর্কী

খাপছাড়া

এক 

অন্যান্য সকল চিন্তার উর্ধ্বে যে-চিন্তাটি তাঁকে প্রায়ই এবং স্পষ্টত ব্যাকুল করতো, তা ছিল ভগবানের চিন্তা। বাস্তবিক পক্ষে, মাঝে মাঝে মনে হোতো, এ যেন কেবল চিন্তাই ছিল না, ছিল তাঁর চেয়ে কোনো উচ্চতর শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রাণপণ প্রতিরোধ-প্রয়াস। এ সম্বন্ধে যতোখানি আলাপ করলে তিনি খুশী হ’তেন ততোখানি আলাপ তিনি করতেন না সত্য, কিন্তু এ-সম্বন্ধে তিনি সর্বদাই চিন্তা করতেন। এ যে বার্ধক্যের চিহ্ন বা আসন্ন মৃত্যুর আতংক, তা-ও বলা চলে না। আমার মনে হয়, এর মূলে ছিল তাঁর মানবিকতার অপূর্ব এক দম্ভ এবং-কতক পরিমাণে হীনতার অনুভূতি। কারণ, লিও টলস্টয় হ’য়েও সামান্য কোনো জীবাণুর কাছে মাথা নত করা হীনতা ছাড়া আর কী। তিনি যদি বৈজ্ঞানিক হ’তেন তবে নিশ্চয়ই বহু কাল্পনিক সূত্রের সৃষ্টি করতেন এবং মহা মহা বিষয় করতেন আবিষ্কার।

দুই

তাঁর হাত দুটি ছিল অপূর্ব সুন্দর নয়, কিন্তু স্ফীত ধমনীতে গ্রন্থিময় এবং সৃজনীশক্তি ও অদ্বিতীয় প্রকাশব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ। সম্ভবত লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতদুটিও ছিল এমনি। এমন সুন্দর যাঁর হাত, তিনি দুনিয়ায় সব কিছুই করতে পারেন। কখনো কখনো কথা বলবার সময় তিনি তাঁর আঙুলগুলোকে নাড়তেন, ধীরে ধীরে সেগুলো নিমীলিত হ’য়ে মুষ্টিতে পরিণত হোতো, আবার অকস্মাৎ উন্মীলিত হোতো, এবং সেই সংগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এক একটি মনোজ্ঞ শব্দ উচ্চারণ করতেন। তিনি ছিলেন দেবতার মতো; ইহুদি বা গ্রীক দেবতার মতো নন, যেন কোনো রুশ দেবতা, যিনি বসে থাকেন সোনালি লেবু গাছের তলায় ম্যাপল্ কাঠের সিংহাসনে। তাঁর মধ্যে খুব বেশি দেবোচিত মহিমা থাকে না সত্য, তবে, সম্ভবত তিনিই দেবতাদের মধ্যে সব চেয়ে চতুর।

তিন

নারীসুলভ কোমল স্নেহের সংগে তিনি দেখেন সুলার ঝিক্কিকে। আর শেখভের প্রতি তাঁর মনোভাবটা পিতৃ-বাৎসল্যের অনুরূপ, এর মধ্যে স্রষ্টার গৌরব-অনুভূতিও আছে খানিকটা। সুলার তাঁর মধ্যে একটা স্নেহের উদ্রেক করে, একটা চিরস্থায়ী কৌতুহল এবং আনন্দ, যা এই জাদুকরটিকে কখনোও ক্লান্ত করে না। হয়তো এই মনোভাবের মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যা একটু হাস্যকর-ও মনে হয়। এ যেন কোনো বৃদ্ধা কুমারীর ভালোবাসা-পোষা কাকাতুয়া, কুকুর বা বিড়ালের প্রতি। সুলার যেন কোনো অজ্ঞাত অদ্ভুত দেশের দুরন্ত চঞ্চল পাখী, প্রচুর তার আকর্ষণ। তার মতো একশো মানুষই একটা গ্রাম্য শহরের বাইরের এবং ভেতরের চেহারাটাকে বদলে ফেলতে যথেষ্ট। বাইরের চেহারাটাকে তারা চূর্ণ ক’রে দেবে, আর ভেতরের চেহারাটাকে তারা পূর্ণ ক’রে দেবে প্রাণ-মত্ত বন্ধু চঞ্চলতায়। সুলারকে মানুষে সহজেই খুশী হ’য়ে আপনা থেকে ভালোবাসে। মেয়েরা তাকে কতো সহজে ও হালকাভাবে গ্রহণ করে, যখন আমি তা লক্ষ্য করি, তখন বিস্মিত ও রুষ্ট না হ’য়ে পারি না। তবু, খুব সম্ভব এই লঘু ভাবটার মধ্যেও বুঝি একটা সতর্ক ভাব তার গোপন থাকে। কারণ, সুলারের ওপর নির্ভর করা চলে না। কাল সে কী করবে কে জানে? হয়তো কোথাও একটা বোমা ছুঁড়ে বসবে, হয়তো কোনো যাত্রা-থিয়েটারে গিয়ে জুটবে। তিনটা মানুষের বাঁচার মতো প্রাণশক্তি তার একার মধ্যে। আর তার জীবনের আগুন-সে যখন ঘেমে ওঠে, তখন অতি- তপ্ত লৌহ-শলাকা থেকে স্ফুলিংগের মতো বিচ্ছুরিত হ’তে থাকে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024