রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন

টলস্টয়ের স্মৃতি (পর্ব-০২)

  • Update Time : রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৪.০০ পিএম

ম্যাকসিম গোর্কী

(ক)

[তবে একবার তিনি সুলারের উপর অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। সুলারের মধ্যে অরাজকবাদের প্রতি ছিল একটা সহজ প্রীতি। তাই সে প্রায়ই ব্যক্তি-স্বাধীনতার সম্বন্ধে তর্ক করতে গিয়ে তিক্ত হ’য়ে উঠতো। ওই সময়ে লিও নিকোলাইয়েভিচ সর্বদাই তাকে কোণ- ঠাসা করতেন।

আমার বেশ মনে পড়ে, সুলার একবার প্রিন্স ক্রপটকিনের লেখা একটা চটি বই কোথা থেকে সংগ্রহ ক’রে এনেছিল; ফলে তার মাথায় যেন আগুন ধ’রে গেল; সে সমস্ত দিন সকলের কাছে অরাজকবাদের জ্ঞানগর্ভতা সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে লাগল; এবং সকলকে নিজের দার্শনিকিয়ানায় প্রায় ঘায়েল ক’রে ফেলল।

“আঃ, থামো তুমি লিওভুশকা! তুমি বড়ো জ্বালাতন করো।” বিরক্ত কণ্ঠে লিও নিকোলাইয়েভিচ বলে উঠলেন, “একটা কথাকে তুমি কাকাতুয়ার মতো বারে বারে আওড়াচ্ছ,-স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা কথাটার অর্থ কী? তুমি যদি তোমার পূর্ণ ব্যক্তি-স্বাধীনতা পাও, তবে তাতে কী হবে তুমি মনে করো? দার্শনিকতার দিক থেকে সেটা হবে একটা অতল শূন্যতা। আর বাস্তবিক জীবনের দিক থেকে তুমি হ’য়ে উঠবে একটি অলস, পরাশ্রয়ী জীব। তুমি যাকে স্বাধীনতা বলছ, তেমন স্বাধীনতা যদি তুমি পাও, তবে জীবনের সংগে, জনসাধারণের সংগে, তোমাকে বেঁধে রাখবে কোন জিনিষটা? পাখীরা স্বাধীন, কিন্তু তবু তারা নীড় বাঁধে; কিন্তু তুমি তো নীড়ও বাঁধবে না; কুকুরের মতো যেখানে-সেখানে তোমার যৌন-ক্ষুধা মিটিয়ে বেড়াবে। তুমি যদি গুরুত্বের সংগে চিন্তা করো, তবে তুমিও দেখতে পাবে, অনুভব করবে, এই স্বাধীনতা আসলে হোলো শূন্যতা, সীমাহীনতা।”

রোষে তাঁর ভ্রু-যুগল কুঞ্চিত হ’লো, তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব রইলেন, তারপর শান্তভাবে আবার বললেন, “খৃস্ট স্বাধীন ছিলেন, স্বাধীন ছিলেন বুদ্ধ। তাঁরা উভয়েই পৃথিবীর সমস্ত পাপের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন এবং স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছিলেন এই পার্থিব জীবনের বন্দীশালায়। তাঁদের চেয়ে আর কেউ বেশি এগোতে পারে নি-কেউ না। আর তোমরা-আমরা-দ্যাখো, এ নিয়ে আলোচনা ক’রে কোনো লাভ নেই; আমরা সকলেই চাচ্ছি, অন্যান্য মানুযের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য আছে, তার হাত থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে। অথচ এই কর্তব্যের অনুভূতি-বোধটাই আমাদের মানুষ করেছে। এবং যদি আমাদের ঐ কর্তব্য-বোধটা না থাকতো, তবে আমরা জন্তু-জানোয়ারের মতো থাকতাম।”

এবার তিনি মৃদু হাসলেন, বললেন, “কেমন ক’রে বাঁচা উচিত, তাই নিয়ে এখন আমরা এখানে তর্ক করছি। ফলটা যে বিরাট কিছু হচ্ছে তা নয়, তবে কিছু হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরো, তুমি আমার সংগে তর্ক করছ, আর এমন রেগে উঠছো যে তোমার নাকটা পর্যন্ত নীল হ’য়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু তুমি আমাকে মারছ না, এমনকি গালও পাড়ছ না। তুমি যদি বাস্তবিক পক্ষে স্বাধীন হ’তে, তবে তুমি এখানেই আমাকে খুন ক’রে বসতে এবং সেই সংগে সব ঢুকে যেতো।”

ক্ষণিক নীরবতার পর তিনি আবার বললেন, “স্বাধীনতা তখনই সম্ভব, যখন সবার সংগে, সব কিছুর সংগে আমার মিল থাকবে। আর সে-ক্ষেত্রে আমার কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কারণ, আমরা কেবল তখনই মাত্র আত্ম-সচেতন হ’য়ে উঠি, যখন আমরা সংঘাত ও বিরোধের মধ্যে এসে পড়ি।”]

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024