কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের কাছে বিজেপির বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছে। বড় জয় পেয়েছেন প্রথমবার ভোটে লড়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
দুটি রাজ্য বিধানসভাসহ কয়েকটি রাজ্যে উপনির্বাচনের ভোটগণনা চলছে শনিবার। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি বিধানসভা আসন। ভোটগণনা হচ্ছে দুটি লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনেরও।
মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকার নির্বাচনের জন্য এখানকার মানুষ ভোট দিয়েছেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সহ ১৪টি রাজ্যের ৪৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট নেয়া হয়েছে। দুটি রাজ্যের দুটি লোকসভা আসনেও নির্বাচন হয়েছে। সকাল আটটা থেকে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে ভোট গোনা।
পশ্চিমবঙ্গের ছয়
এই রাজ্যে আর বছর দেড়েকের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এই স্বল্প মেয়াদের জন্য ছয়জন বিধায়ক বিধানসভায় যাবেন। বিভিন্ন কারণে এই আসনগুলো ফাঁকা হয়েছিল।
উপনির্বাচনে ছক্কা হাঁকিয়েছে তৃণমূল। পাঁচটি আসন তাদের দখলেই ছিল। একটি আসন তারা বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, জয়ের ব্যবধানও বেশ বড়।
কোচবিহারের সিতাই কেন্দ্রে শাসকদলের প্রার্থী সঙ্গীতা রায় জিতেছেন এক লাখ ৩০ হাজার ১৫৬ ভোটে। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া বিধানসভায় শেখ রবিউল ইসলাম হারিয়েছেন আইএসএফ প্রার্থীকে। তার জয়ের ব্যবধান এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৮৮ ভোট। একই জেলার উত্তরে নৈহাটি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী সনৎ দে জয়ী হয়েছেন ৪৯ হাজার ১৯৩ ভোটে।
উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মাদারিহাট বিধানসভায় এ বছরের সাধারণ নির্বাচনেও এগিয়েছিল বিজেপি। এবার তৃণমূলের জয়প্রকাশ টোপ্পো বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়েছেন ৩০ হাজার ৩০৯ ভোটে। তালডাংরার তৃণমূল প্রার্থী ফাল্গুনী সিংহবাবু ৩৪ হাজার ৮২ ভোটে জয় লাভ করেছেন। মেদিনীপুরের তৃণমূল প্রার্থী সুজয় হাজরা ৩৩ হাজার ৯৯৬ ভোটে জয়ী হয়েছেন।
উপনির্বাচনের ফল নিয়ে সমাজমাধ্যমের পোস্টে মমতা লিখেছেন, ‘”আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মা-মাটি-মানুষকে জানাই প্রণাম। আপনাদের এই আশীর্বাদ আমাদের আগামীর চলার পথে আরও সক্রিয় ভাবে কাজ করার উৎসাহ দেবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “২০২১ ও ২০২৪ এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চগ্রামে লড়াই করেছিল বিজেপি। সেই ভোটে হারার পর ধীরে ধীরে অনেক বিজেপি কর্মী-সমর্থক বসে গিয়েছিলেন। তাদের একাংশের ভোট এবার তৃণমূল পেয়েছে। দুটো দলের মধ্যে আদর্শগত ফারাক বিরাট কিছু নেই। তাই শিবির বদলাতে সমস্যা হয়নি। একটা সময় তৃণমূলকে রুখতে বামেদের ভোট বিজেপিতে গিয়েছিল। এবার বিজেপির ভোট তৃণমূলে যাচ্ছে।”
আরজি করের ঘটনা নিয়ে তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল গত তিন মাসে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে তা প্রভাব ফেলেনি কেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, “আরজি কর কাণ্ড নিয়ে মানুষ তৃণমূলের থেকেও বেশি হতাশ বিজেপির উপর। সিবিআই নতুন কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। মানুষ এই গোটা ব্যাপারটাতে ক্ষুব্ধ , হতাশ। এই হতাশার ফলটাই দেখতে পাচ্ছি মাদারিহাটের পতনে।”
সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, “গত ২০-২৫ বছর ধরে যেটা দেশের অন্যত্র নেই বাংলায় আছে, সেই ভোটসন্ত্রাস হলো রাজনীতির একটা মূল উপাদান। কাজেই শাসক দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভোটাররা টার্গেট হয়ে যেতে চান না। বা তারা অজানা ভবিতব্যের দিকে এগিয়ে যেতে চান না। ফলে উপনির্বাচনে আরজিকর কান্ডের প্রভাব পড়বে বলে আমার প্রথম থেকেই মনে হয়নি। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কোনো ইস্যুই ঠিকভাবে ধরতে পারে না। সংগঠিতভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। ”
এই উপনির্বাচনের ফল দেখে কি পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা ভোটের ভবিষ্যৎ বোঝা যাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “২৬ এর বিধানসভা ভোটের কথা যদি বলেন, কোনভাবেই তৃণমূলের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু ভাবার কথা এই মুহূর্তে মানুষ ভাবতে পারছে না। ঝাড়খণ্ডে একটা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কোন সক্রিয় ভূমিকা নেই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের এত দুর্নীতি, চুরি সত্বেও বিজেপি সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারছে না। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার জায়গা আর নেইও। সুতরাং ২৬ এর নির্বাচনে বলাই বাহুল্য যে তৃণমূলই ক্ষমতায় আসবে।”
দুই রাজ্য বিধানসভা
গোটা দেশের নজর ছিল মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে। শুধু বিজেপি বা কংগ্রেস নয়, একঝাঁক আঞ্চলিক দলের অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে এই দুই রাজ্যে।
মহারাষ্ট্রে ২৮৮ কেন্দ্রে ভোট নেয়া হয়েছে। লড়াই বিজেপি ও কংগ্রেসের দুই জোটের মধ্যে। সরকার গড়তে ১৪৫ কেন্দ্রে জয় দরকার।
কঠিন লড়াই মনে হলেও হাসতে হাসতে জিতেছে বিজেপি জোট। কংগ্রেস, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির শরদ পাওয়ার গোষ্ঠী, শিবসেনা উদ্ধব ঠাকরে গোষ্ঠী এবারের নির্বাচনে লড়েছে জোট বেঁধে। তাদের আসন সংখ্যা ৫০ এর আশেপাশে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপি, শিবসেনা শিন্ডে গোষ্ঠী ও এনসিপি অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখতে চলেছে। তাদের আসন সংখ্যা ২০০ পার করেছে। বিজেপি একাই সেখানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
দীপ্তেন্দ্র ডিডাব্লিউকে বলেন, “গত লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে দল এবং আদর্শের চেয়ে অনেক বেশি বড় করে নিজেকে তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেটা মানুষ পছন্দ করেনি, আরএসএস পছন্দ করেনি। বিজেপির পাশ থেকে আরএসএস সরে গিয়েছিল। তার ফলে মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন জায়গায় বিজেপির একটা পতন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু যখন মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে, তখন সেখানে এমন কেউ নেই যিনি নিজেকে দলের থেকে, রাজ্যের থেকে বড় ফিগার হিসেবে তুলে ধরবেন। যার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিক্রিয়া হবে। কাজেই যে ভোটটা সাধারণভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেই ভোটটা আবার বিজেপির পক্ষে ফিরে আসছে।”
একেবারে বিপরীত ভৌগোলিক অবস্থানে পূর্ব ভারতের ঝাড়খন্ড। খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এই রাজ্যে বিধানসভার ৮১ আসনে ভোট নেয়া হয়েছে। ৪২ কেন্দ্রে জিততে হবে সরকার গড়ার জন্য। এখানেও দুটি জোট সম্মুখ সমরে।
এই রাজ্যে বিজেপির জয় রুখে দিয়েছেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেন। তার দল ছাড়াও আরজেডি, কংগ্রেস, সিপিআইএমএলকে নিয়ে যে মহাজোট তৈরি হয়েছিল, তা ৫০টির বেশি আসনে জয় পেতে চলেছে। বিজেপি জোটের প্রাপ্তি ৩০টির মতো আসন।
দীপ্তেন্দ্র বলেন, “মহারাষ্ট্রে আরএসএস এবার ভালোভাবে কাজ করেছে। যেটা আবার ঝাড়খণ্ডে দেখা যাচ্ছে না। শরদ পাওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে যত বড় ছিলেন আগে, এখন আর নেই। এদের দলবদলের খেলায় মানুষ বিরক্ত। এটা নীতীশ কুমারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। শরিকদের কারণে মুখ্যমন্ত্রী থাকেন, কিন্তু খুব কম ভোট পান।”
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, “মহারাষ্ট্রে গত তিন মাসে একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন সরকার নারীদের একাউন্টে টাকা পৌঁছে দিয়েছে। এর অবশ্যই একটা আফটার এফেক্ট আছে। ঝাড়খণ্ডেও হেমন্ত সোরেন জেলে যাবার পর একদিকে তার স্ত্রী কল্পনা সোরেনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং অন্যদিকে মহিলাদের জন্য প্রকল্প কাজে দিয়েছে। বাংলার মডেল সব দলই অনুসরণ করছে। তার ফল সবাই ভোটে পাচ্ছে। এর আগে মধ্যপ্রদেশে আমরা বিজেপিকে এর ফল পেতে দেখেছি। এবার মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট পেল আর ঝাড়খণ্ডে ইন্ডিয়া ব্লক পেল।”
বিধানসভার উপনির্বাচন
শুধু মহারাষ্ট্র বা ঝাড়খন্ড নয়, বিভিন্ন রাজ্যে জনতার মন কিছুটা বোঝা যাবে উপনির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিলে ১৩টি রাজ্যের ৪২ কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশের নয়টি কেন্দ্র। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের দল বিজেপি ও তার সঙ্গীরা সাতটি কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে। দুটি কেন্দ্রে এগিয়ে সমাজবাদী পার্টি।
সবমিলিয়ে ৪২টি কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি সংখ্যার বিচারে অনেকটা এগিয়ে। তারা ২০টি আসনে জেতার পথে। কংগ্রেসের ঝুলিতে নয়, আম আদমি পার্টির দুই।
লোকসভার দুই কেন্দ্র
এই দফার উপনির্বাচনে হাই প্রোফাইল কেন্দ্র কেরলের ওয়েনাড়। এই প্রথম ভোটে লড়ার জন্য কংগ্রেস প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বেছে নিয়েছেন দাদা রাহুলের ছেড়ে যাওয়া আসনকে। গত লোকসভায় দুটি আসনে জেতেন হাত ব্রিগেডের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী। পরে উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি রেখে কেরলের আসন তিনি ছেড়ে দেন।
এই কেন্দ্রে বিপুল সাড়া পেয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। নিকটতম সিপিএম প্রার্থীর তুলনায় তিনি চার লক্ষের বেশি ভোট এগিয়ে থেকে জয় নিশ্চিত করেছেন। বিজেপি প্রার্থী নব্য হরিদাসের চলে গিয়েছেন আরো পিছনে।
মহারাষ্ট্রের নান্দেড় লোকসভা কেন্দ্রেও ভোটগণনা হয়েছে এ দিন। বিজেপি ও কংগ্রেসের জোর লড়াই চলছে। বিজেপি ৪০ হাজার ভোটে এগিয়ে।
Leave a Reply