রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

সাংস্কৃতিক আয়োজনে হুমকি ও প্রশাসনের ‘নতজানু নীতিতে’ উদ্বেগ

  • Update Time : সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১.৪১ পিএম
নারায়ণগঞ্জে ১০ বছর ধরে সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন হয়ে আসলেও এবারই প্রথম হেফাজতের হুমকির মুখে বন্ধ করা হলো৷

হারুন উর রশীদ স্বপন

নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক আয়োজনে বাধাদান ও প্রশাসনের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন সাংস্কৃতিক কর্মীরা৷ হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নতজানু ভূমিকা নেয়ায় সরকারের সমালোচনা চলছে৷

বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে লালন ভক্তদের ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন৷ শুক্র ও শনিবার ওই মেলা হওয়ার কথা ছিলো৷ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় তারা ওই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেননি৷” আর অনুষ্ঠানের আয়োজক ফকির শাহজালাল বলেন, ‘‘হেফাজতের লোকজন আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না দিয়ে মেলা বন্ধ করে দিলো তা দুঃখজনক৷”

আর নারায়ণগঞ্জের নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাফিউর রাব্বি বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসক যা করলেন তা হলো নানা বৈচিত্র্যের সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ করে দিলেন৷ ফলে যারা গায়ের জোর দেখাতে পারবে তারা সবকিছু বন্ধ করে দিতে পারবে৷”

হামলা হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া

নারায়ণগঞ্জের ঘটনাই প্রথম নয়৷ ৫ আগস্টের পর এই নারায়ণগঞ্জেই মাজারে হামলা ও আগুন দেয়া হয়েছে৷ ফরিদপুরে লালন আনন্দধামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে৷ সিলেটে হযরত শাহপরানের মাজারে ওরশে হামলা, শাহজালাল মাজারে হামলার হুমকিসহ আরো কয়েকটি মাজারে হামলা ও লালন মেলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ প্রতিটি ঘটনায়ই হামলাকারী ও যারা হুমকি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ উল্টো মেলা বা গানের আয়োজন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারেও হামলার চেষ্টা হয়েছে৷ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷

নারায়ণগঞ্জের ফকির শাহজালাল বলেন, তিনি ১০ বছর ধরে এই সাধুসঙ্গ ও লালন মেলার আয়োজন করে আসছেন৷ কখনো কোনো সমস্যা হয় নাই৷ এবারই প্রথম হেফাজতের হুমকির মুখে বন্ধ করা হলো৷ তিনি বলেন, ‘‘কুষ্টিয়াসহ সারাদেশ থেকে লালন ভক্তরা এসেছিলেন মেলায় যোগ দিতে৷ অনেকে আমার বাসায় ছিলেন৷ তাদের খেতেও দেয়া হয়নি৷ বের করে দেয়া হয়েছে৷”

নারয়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার কাসিপুরের লালন ভক্তদের এই মেলা প্রতিবছর নভেম্বর মাসের ২২-২৩ তারিখে হয়৷ ১০ বছর ধরে এই আয়োজন চলছে৷ কিন্তু হেফাজতে ইসলাম এবার অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে এই মেলা বন্ধের দাবী জানিয়ে আসছিলো৷ তারা মিছিল সমাবেশও করে৷ নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘‘লালন ভক্ত ফকির শাহজালাল আমার কাছে দুই দিন আগে মেলার অনুমতির জন্য আসেন৷ তবে তার আগেই হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও তার অনুসারীরা আমার সঙ্গে দেখা করে বাউল মেলা বন্ধ করতে বলেন৷ তারা অশ্লীলতা ও মাদক সেবন হবে বলে অভিযোগ করেন৷”

তিনি দাবি করেন, সার্বিক নিরপত্তা বিবেচনা করে মেলার অনুমতি দেননি তারা৷ বলেন, ‘‘কারণ কোনো খারাপ পরিস্থিতি হলে তা নিয়ন্ত্রণের মতো পরিস্থিতি এখানে ছিল না৷ তবে পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা মেলা করতে পারবেন৷”

যাদের শক্তি বেশি তারা তাহলে সবকিছু হুমকি দিয়ে বন্ধ করে দিতে পারবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,” দেশের বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা করতে দিতে হবে৷ তবে বাউলদের এখানে গাঁজা সেবনসহ আপত্তিকর কিছু হয়৷ যা মুসলিম অনুভূতিতে আঘাত করে সেটাও দেখতে হবে৷’’

আর হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল আউয়াল দাবী করেন, ‘‘তাদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতাসহ মাদক সেবনের অভিযোগ আগে থেকেই আছে৷ এলাকার তরুণ যুবকদের তারা নষ্ট করছে৷ গানের নামে নারীদের নাচানো হয়৷ সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এবার আমরা প্রতিরোধ করেছি৷ ভবিষ্যতে এখানে আর কথানোই বাউল মেলা হতে দেব না৷”

হেফাজত নেতার কথা প্রেক্ষিতে ফকির শাহজালাল বলেন,” কোনো ধরনের অশ্লীলতা বা মাদক সেবন এখানে হয় না৷ আমরা লালনের গান গাই৷ বাউল সাধনা করি৷ প্রশাসন আসলে তাদের পেশি শক্তি ও আর্থিক শক্তির কাছে মাথা নত করেছে৷ আমাদের শক্তি নেই৷ তাই আমাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে৷ আমার কাছে আর এই দেশকে স্বাধীন মনে হয় না৷ তারা আমাকে নাস্তিক বলে হত্যার হুমকি দিয়েছে, কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷”

রাফিউর রাব্বি বলেন, ‘‘আমরা নারায়ণগঞ্জের মানুষ লালন মেলা বন্ধ করার প্রতিবাদ জনাচ্ছি৷ আমরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ শুরুতে তিনি বলেছিলেন বাউলদের নিরাপত্তা দেয়া হবে৷ কিন্তু পরে তিনি অনুষ্ঠানই করতে দিলেন না৷ পুলিশ দিয়ে বাউলদের তাড়িয়ে দিলেন৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা রক্ত দিলাম কিন্তু সেই চেতনার বিরুদ্ধে গেলাম৷ আমরা যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতিকে ধারণ করার কথা বলছি সেটা তো হচ্ছে না৷ আমরা যে ইনক্লুসিভ সোসাইটি গড়ার কথা বলছি সেটা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি৷’’

‘নতজানু নীতির কাছে আটকে যাচ্ছে সরকার’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতিমা ডয়চে ভেলেকে বলেন,” সরকার হয়তো ভেবেছে ওইখানে এমন কোনো পরিস্থিতি হতে পারে যা সরকার হয়তো সামাল দিতে পারবে না৷ কিন্তু সরকার যদি এইভাবে কাজ করে তাহলে ভবিষ্যতে কিন্তু বড় ধরনের বিচ্যুতি হতে পারে৷ সরকারের এটা ভাবা উচিত৷ ”

তার কথা, ‘‘যাদের ক্ষমতা বেশি, যারা ঝামেলা করতে পারে সরকার যদি তাদের প্রাধান্য দেয় সেটা কিন্তু সরকারের দায়িত্বহীনতা৷ সরকার তো হেফাজতকে সমাবেশ করতে বাধা দেয় না৷ তাহলে বাউলদের মেলা করতে দেবেনা কেন? সরকারের এই দায়িত্বহীন আচরণ ঠিক না,” বলেন তিনি৷

তিনি বলেন, “আমরা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য চাই৷ ৫ আগস্টের পর মাজারে হামলা চালিয়ে একটা খারাপ পরিস্থিতির চেষ্টা করেছিলো দুর্বৃত্ব এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা৷ কিন্তু এই সমাজই সেটা প্রতিরোধ করেছে৷ কারণ এই দেশের মানুষ ওটা চায় না,” বলেন তিনি৷

মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন কারো চাপের কাছে সরকারের নতি স্বীকার করার সুযোগ নাই৷ বলেন,” কারো দাবিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়া কোনোভাবেই ঠিক না৷ বাউলদের প্রোগ্রাম এখানে যুগ যুগ ধরে হচ্ছে৷ এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ৷ কোনো একটি মহলের দাবীতে সরকার যখন সেটা বন্ধ করে দেয় তখন বুঝতে হবে সরকার যেকোনো কারণেই হোক একটা নতজানু নীতির কারণে আটকে যাচ্ছে৷ সরকারকে এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷”

ডিডাব্লিউ ডটকম

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024