ফেসবুকের ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ নামের একটি গ্রুপে সোমবার সকাল সাড়ে দশটায় জীবন আহমেদ নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, “আগারগাঁও চৌরাস্তা বন্ধ করে রিকশাওয়ালাদের আন্দোলন শুরু। এই রাস্তা এড়িয়ে চলুন। সময়: ১০:৩০”। ওই একই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে একই গ্রুপে আসিফ খান শাওন লিখেছেন, “আগারগাঁও এড়িয়ে চলুন। গুলশান যাওয়ার পথ থেকে ফিরে এলাম। আগারগাঁওয়ের পর যাওয়া যাচ্ছে না।”
মূলত আগারগাঁওয়ে রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান নিয়েছিলো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা, আর সে কারণেই পুরো এলাকায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায় সকালেই। আবার আগারগাঁওয়ে যখন এই অবস্থা তখন ঢাকার দক্ষিণ-পূর্বে ডেমরায় তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছিলো।
সব মিলিয়ে এসব ঘটনায় অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকার যান চলাচল। বিভিন্ন এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বহু মানুষকে।
অবশ্য এ চিত্র শুধু আজ সোমবারেরই নয়। বরং অগাস্টে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কখনো বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, সংগঠনের দাবি আদায় কিংবা কখনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে বড় বড় সংঘর্ষ হতে দেখা যাচ্ছে ঢাকায়।
সব মিলিয়ে সম্প্রতি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ট্রাফিক সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় সামাজিক মাধ্যমের এমন গ্রুপগুলোতে এখন সকাল হলেই উদ্বিগ্ন মানুষের পোস্ট চোখে পড়ে।
এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিকে অপসারণ, চুরি কিংবা স্বজনের চিকিৎসা ভুল হয়েছে এমন অভিযোগেও রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে সে প্রশ্নও উঠছে যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে তারা এ বিষয়ে সচেষ্ট আছে। পাশাপাশি সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করারও আহ্বান তাদের।
রাস্তাঘাট বন্ধ করার এসব ঘটনাকে অন্যদের জিম্মি করে দাবি আদায় কিংবা চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা, যার ফলে নির্বিঘ্নে যানবাহন ও জনচলাচল মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে।
“এর লাগাম টেনে ধরা জরুরি। জনচলাচল ও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে যে ভীতি তৈরি হয়েছে তা দূর করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হওয়া উচিত। একই সাথে কারও যৌক্তিক দাবি থাকলে তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আলোচনা করে সমাধান করা দরকার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।
একজন ক্ষুব্ধ নাগরিকের প্রতিক্রিয়া
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কয়েকদিনে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকার রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। আবার সচিবালয়ে আনসার সদস্যদের বিক্ষোভও ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো।
এর প্রেক্ষাপটে গত ২৬শে অগাস্ট বাংলাদেশ সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার আশেপাশে যেকোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এরপরেও বিভিন্ন ঘটনায় নানা জায়গায় রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছিলো। এর মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় আসে ঢাকার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে সড়ক ও ট্রেনপথ অবরোধ করে তারা।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন স্থগিত করার পর আলোচনায় এসেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা। তারা গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় জমায়েত হয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।
গত বুধবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকার মহাখালী, আগারগাঁও ও মাজার রোড এলাকা অবরোধ করে তারা।
আবার গত সপ্তাহেই বাসে ওঠার সময় কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে নিউমার্কেট সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকাকে রণক্ষেত্র বানিয়েছিলো ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সংঘর্ষ চলেছে পরপর কয়েকদিন।
রবিবার কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো পত্রিকার বিরুদ্ধে একদল ব্যক্তির কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষ চলেছে মধ্যরাত অবধি।
আবার একই সময়ে তেজগাঁও এলাকায় কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে রাত দুইটা পর্যন্ত সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটির (বুটেক্স) শিক্ষার্থীরা।
সবশেষ আজ সোমবার সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার পর ওই এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকা ও আশেপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে রবিবার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের কিছু শিক্ষার্থী সোহরাওয়ার্দী কলেজে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেছিলো।
ছবিটি ট্রাফিকএলার্ট গ্রুপ থেকে নেয়া
সামাজিক মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক সংক্রান্ত গ্রুপগুলোতে দিনভর দেখা যাচ্ছে উদ্বিগ্ন মানুষদের পোস্ট।
এসব পোস্টে তারা জানতে চান তাদের গন্তব্যের রাস্তাটি বন্ধ আছে নাকি সচল আছে। কিংবা কেউ কোথায় রওনা দেয়ার আগে পোস্ট দিয়ে জানতে চান যে তিনি তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না।
অর্থাৎ ঢাকায় কখন কোন রাস্তা বন্ধ হবে কিংবা কারা কখন কোন রাস্তা বন্ধ করে দিবে- সেটিই এখন বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর জন্য।
লরনা জেসিকা ডি মন্টে ফেসবুকে ট্রাফিক এলার্ট গ্রুপে লিখেছেন, ‘মগবাজার থেকে টঙ্গীর রাস্তায় কোনো ঝামেলা হচ্ছে’? আবার শুভজিৎ সাহা লিখেছেন ‘ফার্মগেট থেকে নিকুঞ্জে রুট আপডেট জানা দরকার’।
আব্দুল্লাহ আল সৌদ রবিবার রাতে লিখেছিলেন ‘ঢাকা শহর এর উপর দিয়ে মনে হয় আজকে কুফার গজব গেসে! পুরান ঢাকায় ভাঙচুর, রিক্সা আন্দোলন, সর্বশেষ কাওরান বাজারে গণ্ডগোল.. আর কি বাকি আছে?’
আবার আজই সাব্বির মাহবুব লিখেছেন ‘আজকে কি মতিঝিল কিংবা প্রেসক্লাবের দিকে কোন মিছিল, মিটিং, সমাবেশ আছে কিংবা চলছে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলছেন, কেউ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আবার কেউ ভুল বুঝাবুঝির সূত্র ধরে অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়ছেন।
“সব মিলিয়ে মানুষের ভোগান্তির ঘটনা বাড়ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগুলো হচ্ছে। আর এগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া। মানুষকে খোঁজ নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে যে তিনি ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. হক বলছেন অনেকে অধিকারের কথা বলতে এসেও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত ভাঙচুর হচ্ছে।
“অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে অন্যকে বাধা না দিলে দাবি আদায় হয় না- এমন ধারণা পোষণ করছেন অনেকে। অন্যদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশল এটি। তাই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হওয়া দরকার। আবার কারও যৌক্তিক দাবি থাকলে সেটি একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকা দরকার,” বলছিলেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে জানতে চাইলে তার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, সরকার মানুষের দাবি দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং যৌক্তিক হলে সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত। তবে কেউ বাড়াবাড়ি করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ কী করছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ বা ডিএমপি বলছে, সংকট নিরসনে তারা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে এবং একই সঙ্গে সবার দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছে।
“আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি যাতে জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটে এমন কিছু কেউ যেন না করতে পারে। কোথাও কিছু ঘটলেই আমরা চেষ্টা করছি আইনানুগ পন্থায় তার সমাধান করতে। পুলিশও সবার দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার ও মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
বিবিসি বাংলা
Leave a Reply