স্বদেশ রায়
বাংলাদেশ ও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায় নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক ন্যারেটিভও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বইয়ের বাইরে এসে ওরাল হিস্ট্রি শুনতে শুনতে- বিশেষ করে যাদের হাত ধরে এর শুরুটা তাদের কথা ও লাইন বিটুইন সে সব কথার অর্থ- কেন যেন একটা স্থির সিদ্ধান্তে সব সময়ই অচল থাকার মত উপাদান খুঁজে পেয়েছি। আর তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ৪০ এর দশকের প্রগতিশীল মুসলিম তরুণ ছাত্ররা- যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন পেশায় নিজেকে উজ্জল করেছেন, সৃষ্টি করেছেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে অনেক কিছু- এই প্রজম্ম ও তাদের আধুনিক চিন্তা চেতনা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বীজ তাদের কাজের ভেতর দিয়ে এ মাটিতে বুনেছিলেন।
এই ক্ষুদ্র জীবনের সৌভাগ্য হলো, তাদের অনেকের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান কাটিয়ে দীর্ঘ সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। তাদের কেউ কেউ আটচল্লিশ বা তার বেশ কিছু আগের নেতা, আবার কেউ কেউ ৫২ এর নেতা।
যাদের কাছে বার বার যাবার সৌভাগ্য হয়। শোনার সৌভাগ্য হয় সে সময়ের কথা- তাদের ভেতর ৪৮ থেকে ৫২ এর নেতাদের মধ্য অনেকেই আছেন।
এদের ভেতর যেমন কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছি কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুর রাহমান খান, শামসুর রহমান খানের বড় ভাই আতাউর রহমান খান( যিনি মূখমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) (যিনি আরো একটু আগের), কমরেড তোহয়া, অলি আহাদ, বাহাউদ্দিন চৌধুরি। তেমনি ৫২ তে এসে যারা নেতৃত্ব দিলেন, হাবিবুর রহমান শেলী( পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) গাজী উল হক, এম আর আক্তার মুকুল, নুরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ (মুক্তি যুদ্ধের সময় যিনি তার নামের সঙ্গে আজাদ যোগ করেছিলেন) আব্দুল মোমিম তালুকদার, ভাষা মতিন প্রমূখ। তেমনি ৫২ এর প্রথম ১৪৪ ধারা ভাঙা সাহসী নারী একজন রওশন আর বাচ্চু সহ আর অনেকের সঙ্গে।
এরা সকলেই ৪৭ এর ১৪ আগষ্ট অবধি কমবেশি পাকিস্তান চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলে বুঝেছি, ৪৬ এর দাঙ্গা তাদেরকে যেমন বেশি ভাবিত করেছিলো, তেমনি তারা পাকিস্তান প্রাপ্তির ভেতর কোন বীরত্ব খুঁজে পাননি। আর পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে যে কোন বীরত্ব ছিলো না তা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও বলেন, তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের ঠাট্টা করে বলতেন, পাকিস্তান সৃষ্টিতে তাদের কোন অবদান নেই। পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন তিনি ও তার স্টেনোগ্রাফার।
বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টি বা ভারত ভাগ ছিলো পশ্চিমা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি মাস্টার প্লান। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ভারতবর্ষ থেকে নৌ ও স্থল পথের পশ্চিমা যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করা। এ বিষয়ে লিখতে গেলে লেখা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। তবে ভবিষ্যতের শিক্ষিত প্রজম্ম ও সঠিক প্রজম্ম ঠিকই জানবে ভারত ভাগের সঙ্গে বা পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে কোন ধর্মের যোগ ছিলো না। একটি অপরিনত জাতিকে পশ্চিমা শক্তি ধর্মের উম্মাদনায় বিভক্ত শুধু নয় -ভাই হত্যা থেকে মাতার শ্লীলতা নষ্ট অবধি নামিয়েছিলো।
যাহোক, পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৫০ মোগলটুলি কেন্দ্রিক (মুসলিম লীগের কর্মী ক্যাম্প) এই নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলার ভেতর দিয়ে একটি বিষয় বার বার লক্ষ্য করেছি- তারা সকলে প্রজ্ঞাবান ও বীর ছিলেন। ঋষি অরবিন্দ’র গীতার ভাষ্যে’র একটি কথা পরম সত্য যে প্রজ্ঞা বা নলেজ ছাড়া কখনও বীর হয় না। ওপরে যাদের নাম করেছি, এবং জীবনে এই মাপের যত মানুষের সঙ্গে মিশেছি সকলকে দেখেছি তারা সকলেই বীর। আর তাদের প্রজ্ঞা বা নলেজই তাদেরকে বীর হিসেবে তৈরি করেছে।
বীরের চরিত্রের সব থেকে বড় বিষয়, সে যদি বীরত্ব ছাড়া কোন কিছু পায় তা কখনই তাকে সন্তুষ্ঠু করে না। পৃথিবীর সকল মহাকাব্যের সকল বীর থেকে শুরু করে পৃথিবীর যাবতীয় বীর কিন্তু কখনই কোন কিছু কোন চতুরতার ভেতর দিয়ে বা কারো সাহায্যে পেতে চায়নি। সে সব সময়ই তার বীরত্ব দিয়ে জয় করতে চেয়েছে।এমনকি মহাভারতের নায়ক অর্জুনও তার স্ত্রী, দ্রৌপদি, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রাকে বীরত্ব দিয়েই জয় করেছিলো। আবার সিজারও ক্লিওপ্রেটাকে, জাহাঙ্গীরও নুরজাহানকে জয় করেছিলো বীরত্ব দিয়ে।
তাই বীর যদি তার বীরত্বকে প্রকাশ করতে না পারে তাহলে তার থেকে আপসোস ওই বীরের আর কিছু থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তাকে ঘিরে যে ইতিহাসের নায়কদের কথা উল্লেখ করেছি, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনায় মনে হয়েছে, ১৯৪৭ এ উফতে পাওয়া পাকিস্তান তাদের বীরত্বকে অপামান করেছিলো। তাই তারা উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো তাদের বীরত্ব প্রকাশে। যে বীরত্ব তাদেরকে নতুন দেশ, স্বাধীন ও আধুনিক দেশ তৈরির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
আর একটি সত্য বলতে হবে এখানে তাদের কথার লাইন বিটুইন বুঝতাম তাদের ভেতর একটা যন্ত্রনা ছিলো- কারণ মূলত রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কালচারে কোথাও বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমের কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু ১৯৪৭ এসে তারা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বীর হিসেবে যারা ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে, তারা তাদেরই বাঙালি ভাই শুধু সম্প্রদায়ে হিন্দু। এবং বীর হিসেবে তারাই সংখ্যাগরিষ্ট।
যেমন ভারত ও পাকিস্তানের জাতির পিতা হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু যতই পশ্চিমারা যুদ্ধাপরাধী বলুক না কেন, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী ও বঙ্গোপসাগর অবধি বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা শ্রেষ্টবীর হিসেবে ততদিনে স্বীকৃত হয়েছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। আর ওদিকে ঋষি অরবিন্দ, বারীন ঘোষ থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, আর বীর চট্টলার মাস্টার দা সূর্যসেন, গনেষ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী এমনি হাজার বিপ্লবীর রক্তস্নাত বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ। সেই ধারায় তারা যোগ দিতে পারেনি। এই না পারার বেদনা ও তাদের ভেতরের প্রকৃত বীরত্বই কিন্তু বীজ বোনে স্বাধীন বাংলাদেশের। নিজস্ব ভূমি’র, ভাষার ও সংস্কৃতির। আর সেখানে ছিলো না কোন সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নমাত্র। কারণ, সাম্প্রদায়িকতা ক্ষুদ্র, বীরকে কখনও সাম্প্রদায়িকতা ছুঁতে পারে না। বরং বীর অনেক সময় দুর্বল বা ধর্ম, বর্ণ গোত্রের নামে ভাগ করা সংখ্যালঘুর অধিকারের পক্ষে থাকে -তখন কেউ কেউ অজ্ঞতা দিয়ে তাদেরকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বা বর্ণবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে ভুল করে। যেমন অনেক পশ্চিমা লেখক তাদের বোধের স্বল্পতার কারণে ইয়াসির আরাফাতকে সাম্প্রদায়িক মনে করেন। অনেক আমেরিকানও ঠিক একই কারণে মার্টিন লুথার কিংকে বর্ণবাদী আন্দোলনের নেতা মনে করেন। তারা তাদেরকে মানবতার নেতা মনে করতে ভুল করেন।
প্রকৃত কবিও সব সময়ই বীর। তাই সেও কখনও ভুল করে না যেমন ৫২ তে এসে কবি আল মামুদ লিখছেন, “ চিনতে না কি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরামকে চিনতে? / রুদ্ধ শ্বাসে প্রাণ দিলো যে / মুক্ত বাতাস কিনতে?
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম ফাঁসির রজ্জুকে চুমু দেয় যে কিশোর সেই ক্ষুদিরাম ৫২ তে এসেও আল মামুদের নায়ক। আবার বীর চট্টলার যে বীরকন্যা প্রীতিলতা, যে ব্রিটিশের নাগপাশ থেকে দেশ ও মানুষকে মুক্ত করতে গেরিলা হিসেবে আবির্ভূত হলো- তাকে নিয়ে আল মামুদ ওই কবিতাতেই লিখেছেন, “পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায় / ঝাঁপ দিলো যে অগ্নি,/ ফেব্রুয়ারির শোকের বসন /পরলো তারই ভগ্মি।/অর্থাৎ ৪৮, ৫২, ৬৬, ৬৯.৭১ এই সব ক’টি প্রজম্মকে আন্দোলিত করেছিলো ব্রিটিশ বিরোধী এই নিজ প্রাণ দেশ ও মানুষের জন্য তুচ্ছ প্রমান করা তরুণ তরুণীরা।
আর শুরুতে যাদের নাম বলেছি, তাদের সকলের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, প্রাণ শক্তি দিয়ে একটি আধুনিক দেশ না তৈরি করতে পেরে তাদের একটা অব্যক্ত যাতনা ছিলো। আর এই যাতনার মূল ছিলো তাদের প্রজ্ঞা, তাদের জ্ঞান, তাদের মানবতার ধর্ম। তাই তারা মানবতার নামে একটি দেশ খুঁজতে বের হয় পাকিস্তান সৃষ্টির পরদিন বা এমনকি ৪৬ এর দাঙ্গার পর থেকেই। এরা হয়তো সকলে এক মত, এক পথে থাকতে পারেনি। কিন্তু তাদের বীরত্ব, তাদের দেশ ও মানুষের প্রতি মমত্বও সর্বোপরি তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শক্তি থেকে তারা এক চুল বিচ্যূত হয়নি। আর তাদের আলোর রশ্মিতে তারা তৈরি করেছিলো একটি বীর শ্রেনী। যারা ১৯৭১ এর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। যারা একটি দেশ সৃষ্টির জন্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। আর তাদের পূর্ববর্তী প্রজম্ম যারা নেতৃত্বে ছিলেন বা নেতৃত্ব থেকে একটু দূরে সরে গেলেও চিন্তার নায়ক ছিলেন তারা। তাই তারাও ক্ষুদিরামের মতো সোনার ছেলে হয়ে উঠেছিলো। তাই তাদেরকে ভাগ করা যায়নি, ধর্ম ও বর্ণে । বরং যে বীর চট্টলার যে সূর্যসেন সেদিন অসম শক্তি হয়েও ফাঁসির রুজ্জুকে চুম্বন করে স্বাধীনতার স্বাদের সূচনা করেছিলেন- তার নামেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম দেয় সূর্যসেন হল।
আর এবাবে ৪৬ থেকে ৭১ এর ঢাকা কেন্দ্রিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক প্রজ্ঞাবান তরুণ প্রজম্ম সমানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়- যারা আগে নিঃশেষে প্রাণ দান করে গিয়েছিলো তাদের পাশে। যেন তারা এক সঙ্গে একই সারিতে দাঁড়িয়ে গাইতে পারে “উদয়ের পথে শুনি কার বানী,/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, / ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
লেখক:রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply