মাক্সিম গোর্কি
সকাল থেকে প্রবল ধারায় বাহ্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়েছে। দুপুরের দিকে জোর ফুরিয়ে এল মেঘের, তাঁদের ঘন বুনোট ফেঁসে ফেঁসে গেল, বাতাসের তোড়ে তাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে একরাশ পাতলা স্বাচ্ছ ন্যাতার মতো করে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল সমুদ্রের মধ্যে, সেখানে ফের তা আবার নীল-ধূসর এক ঘন মেঘ হয়ে জমাট বেঁধে গাঢ় ছায়া নামাল বর্ষণ শান্ত জলের ওপর।
পূবের দিকে আকাশ কালো, অন্ধকার চিরে যেতে লাগল বিদ্যুতের ঝলকে, আর দ্বীপখানাকে চোখ ধাঁধানে। আলোর ভরে দিল দেদীপ্যমান এক সূর্য।
দূরে সমুদ্রের বুক থেকে তাকিয়ে দেখলে দ্বীপটাকে নিশ্চয়ই মনে হতো পার্বনের দিনের এক সমৃদ্ধ-মন্দির। সব কিছুই ভারি ঝকঝকে রকমের পরিষ্কার, টকটকে ফুলে চারিদিক ভরা, বৃষ্টির
বড়ো বড়ো ফোঁটা চকমকিয়ে উঠছে চারিদিকেই আঙুরের হলদেটে কচি পাতার ওপর তা দেখাচ্ছে পোখরাজের মতো, উইস্তারিয়ার গুচ্ছের ওপর তা যেন এক একটা পদ্মরাগ মণি, বক্তিম জিরেনিয়মের ওপর তা যেন পাল্লা, আর যাসের ওপর তা ছড়ানো যেন রাশি রাশি মরকত।
বর্ষার পরে যে স্তব্ধতা নামে তাতে চুপ করে আছে পৃথিবী। একমাত্র শব্দ শুধু ঝরণার কোমল ঝঙ্কারে সে ঝরণা লুকিয়ে বইছে পাথরগুলোর কোন পাশ দিয়ে ইউফোরবিয়া, ডিউবেরি, আর পাক খাওয়া, সুরভি ভরা ক্লেমাটিসের শেকড়গুলোর তল দিয়ে। নিচে সমুদ্রের মসৃণ শব্দ।
ফার্জ ফুলের সোনালী কাঁটাগুলো আকাশের দিকে উচানো, জলে ভারি হয়ে দুলছে মৃদু মৃদু নিঃশব্দে যে জল মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে ওই অদ্ভুত দর্শন ফুলগুলো থেকে।
সজল শ্যামল এই প্রেক্ষাপটে হালকা-লান উইস্তারিয়া যেন পাল্লা দিয়েছে রক্ত-লাল জিরেনিয়ম আর গোলাপের সঙ্গে। ক্লেমাটিস্ ফুলের মরচে-হলুদ ঝালরের মধ্যে আইরিস্ আর জিলি ফুলের কালো মখমল বুটি। সব কিছু এমন জ্বলজ্বলে এমন টকটকে যে মনে হয় বুঝি বেহালা, বাঁশী আর আবেগ ভর। সেলোর মতোই ফুলগুলো থেকেও ঝঙ্কার উঠছে সুরের।
পুরনো মদের মতো ভেজা বাতাসটা মদির আর সুরভিত। ধূসর একটা শিলাস্তূপ বিস্ফোরণে ভাঙাচোরা – ফাটলগুলোর চোখে পড়ে পোড়া অক্সিডাইড্ লোহার দাঁগ। এই শিলাস্তূপের তলে, ডিনামাইটের টক-গন্ধ-ওঠা ছাই-ছাই হলদেটে পাথরনুড়ির মাঝখানে চারজন খনি মজুর তাদের দুপুরের খাওয়া ভাগ করে খাচ্ছিল। হৃষ্টপুষ্ট চেহারা লোকগুলোর, পরনে ভেজ। ন্যাতাকানি, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল।
আলু আর বিলিতি বেগুনের সঙ্গে জলপাই তেলে ভাজ। অক্টোপাসের কড়া মাংসে একটা মস্তবড়ো পাত্র ভর্তি-তা থেকে ওর। খাচ্ছিল ধীরেসুস্তে, পরিতৃপ্তি করে, তার সঙ্গে পালা করে একটা বোতল থেকে লাল মদ খাচ্ছিল ঢোক ঢোক করে।
ওদের মধ্যে দাড়ি গোঁপ কামানো দুজনের চেহারা এত একরকম বে বোঝাই যায় তারা ভাই, এমন কি যমজ ভাই-ও হতে পারে। তৃতীয় জন হল একটি বেঁটেখাটে। একচোখ কাণা একটি লোক, পা দুখানা ধনুকের মতো বাঁকা, ছটফটে, শুকনো শরীর, তাতে ওকে দেখাচ্ছিল একটা বুড়ো রোঁয়া-উঠা পাখির মতো। চতুর্থ জন মাঝারি বয়সের এক দাড়িওয়ালা লোক, চওড়া কাঁধ, বাঁকা নাক, মাথায় অজস্র পাকা চুল।
মস্ত এক টুকরো রুটি ভেঙে সে তার মদে ভেজা মোচটা মুছে নিলে, তারপর মুখের অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে গুঁজে দিলে টুকরোটা। লোকটা বলছিল, ‘বাজে কথা।’ দাড়ি-ভরা চোয়ালটা তার একটানা চিবিয়ে চলেছে, ‘মিথ্যে কথা! অন্যার কিছুই আমি করিনি…’
মোটা মোটা ভুরুর নিচে বাদামী রঙের চোখ দুটোয় তার একটা নিরানন্দ পরিহাসের ভাব। গলার স্বর ভারি আর কর্কশ, কথা কইছিল বীরে ধীরে, দ্বিধাগ্রস্তের মতো। তার সবকিছু থেকে তার টুপি, তার রোমশ ডাকাতে মুখ, বড়ো বড়ো হাত আর শাদা শাদা পাথরের ধূলোয় ভরা তার নীল স্যুট-এ সব কিছু থেকেই বোঝ। যাচ্ছিল যে বিস্ফোরণের জন্যে পাহাড়ের পাথর ফুটো করার ভারটা ওরই ওপরে।
তিন জন সঙ্গী মজুর মন দিয়ে ওর কথা শুনছিল। সে কথায় কেউ বাধা দিচ্ছিল না ওকে শুধু মাঝে যাবো ওর। মুখ তুলে তাকাচ্ছিল এমন ভাবে যেন বলতে চাইছিল:
‘তারপর…’.
লোকটা বলে চলল, কথার সঙ্গে সঙ্গে পাকা ভুরু দুটো নামা- ওঠা করে চলল ক্রমাগত।
‘লোকটা আন্দ্রে গ্রা্যো বলে সবাই ডাকে ওকে- লোকট। আমাদের গাঁয়ে এসেছিল যেন এক রাত বিবেতের চোর। পরনে ছেঁড়া খোঁড়া পোষাক, যেমন টুপির রঙ, তেমনি বুটের রঙ- দুটোই সমান ছেঁড়া। লোকটা ছিল যেমন লোভী, তেমনি নির্লজ্জ, তেমনি নিষ্ঠুর। আর সাত বছর যেতে না যেতেই গাঁয়ের বুড়োরা সবাই তাকে টুপি খুলে সেলাম জানাতে শুরু করল- কিন্তু সে বড় জোর একটু মাখা নাড়ত। চল্লিশ মাইলের মধ্যে এমন লোক নেই যে ওর কাছ থেকে কর্জা না খেয়েছে।’
‘যা বলেছো, এমনি লোক আছে বৈকি।’ ধনুক-পায়া লোকটা মন্তব্য করলে নিঃশ্বাস ফেলে, মাথা নেড়ে।
কথক একবার তাকাল ওর দিকে।
বিদ্রূপ করে জিগ্যেস করলে, ‘এই জাতের লোকের সঙ্গে তোমারও সাক্ষাৎ ঘটেছে তাহলে?’
বুড়ো লোকটা চুপ করে হাত নাড়লে। দাড়ি গোঁপ কামানো লোক দুটো হেসে উঠল একসঙ্গে। বাঁকা নাকওয়ালা ব্লাস্টার এক ঢোক মদ গিলে নীল আকাশে উড়ন্ত একটা বাজপাখিকে লক্ষ্য করতে করতে বলে চলল:
‘আমি তখন তেরো, ‘ওর বাড়িতে পাথর বইবার কাজে আর কয়েক জনের সঙ্গে আমাকে ও মজুর ধরেছিল। আমাদের সে জানোয়ার বলেও জ্ঞান করত না। আমার সঙ্গী লুকিনো যখন তাকে সে কথা জানাল, ও বললে, “গাধাটাও আমার নিজের জিনিস, কিন্তু তুই তো আমার কেউ নোস, তোদের দয়া করে কি লাভ আমার?” এই কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে বিঁধল আমার মনে। সেদিন থেকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ওকে। লোকটা সকলের সঙ্গেই নীচ আর নিষ্ঠুর ব্যবহার করত, এমন কি মেয়ে বুড়ো সকলের সঙ্গেই কাকেও খাতির করত না। ভালো মানুষেরা যখন বলত অন্যায় হচ্ছে, সে মুখের ওপর হেসে উঠত। বলত, “আমি যখন গরিব ছিলাম, কেউ তো আমার সঙ্গে এর চেয়ে বেশি ভালো ব্যবহার করেনি।” ও মিশত পুরুত, আর বন্দুকধারী সেপাই পুলিশের সঙ্গে। বাকি লোকজনের সঙ্গে তার দেখা হত কেবল তখন যখন তারা কোনো বিষন বিপদে পড়ত- আর তখন তাদের নিয়ে সে যা খুশি তাই করতে পারত।’
ধনুক-পায়া লোকটা ফের চাপা গলায় মন্তব্য করলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ রকম লোক আছে বটে।’ অন্য তিন জন ওর দিকে তাকাল সহানুভূতি নিয়ে: দাড়ি গোঁপ কামানো লোক দুটোর একজন নীরবে মদের বোতলটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। বোতলটা নিয়ে মুখে ঢালবার আগে বুড়ো আলোর দিকে তুলে ধরল সেটাকে, তারপর বললে: ‘নাডোনার পবিত্র হৃদয়ের জন্যে পান করা যাক!’
‘লোকটা প্রায়ই বলত, “গরিবেরা খাটে বড়ো লোকদের জন্যে, বোকারা খাটে বুদ্ধিমানের জন্যে- চিরকাল তাই হয়ে এসেছে, তাই চলবেও চিরকাল।””
কথক হেসে হাত বাড়ালে বোতলটার দিকে। বোতলটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। অবহেলায় সেটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিলে পাথরের ওপর যেখানে পড়েছিল কোদাল, গাঁইতি, হাতুড়ি আর কালো কালো সাপের মতো ফিউজ তারের টুকরোগুলি।
‘আমি তখন বাচ্চা, এ সব কথায় বেদম রাগ ধরে যেত আমার। সঙ্গী মজুরদেরও তাই হত। কেননা এ সব কথা শুনলে ভাগ্যে একটা জীবনের জন্যে আমাদের আশা আকাংক্ষা সব নিভে যেত। একদিন বেশ রাত হয়েছে, আমি যার আবার বন্ধু লুকিবোর সঙ্গে ওর দেখা হয়ে গেল। ও তখন ঘোড়ায় চেপে মাঠ পেরিয়ে আসছে। ওকে থামিয়ে ভদ্রভাবে কিন্তু বেশ জোর দিয়ে আমরা বললাম, “লোকের সঙ্গে আপনি সদয় ব্যবহার করুন এই আমাদের অনুরোধ।””
দাড়ি গোঁপ কামানো লোক দুটো হাসিতে ফেটে পড়ল, একচোখ কাণা লোকটাও মৃদু মৃদু হাসলে, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে কথক: ‘ব্যাপারটা নেহাৎ বোকামি হয়েছিল, তা সত্যি। কিন্তু যৌবন হল গে অকপট। কথার যে শক্তি, তাতে যৌবন বিশ্বাস করে। বলতে পারো, যৌবন হল গে জীবনের বিবেক…’
বুড়ো বললে, ‘তারপর, কি জবাব দিলে সে?’
‘ও গর্জন করে উঠল, “ঘোড়ার পথ ছাড, পাজীর দল কোথাকার!”
Leave a Reply