মাক্সিম গোর্কি
পিস্তল বার করে সে আমাদের দিকে তাক করলে। আমরা বললাম, “আমরা আপনাকে ভয় দেখাতে আসিনি গ্রাসা, রাগারাগি করবেন না, আমরা শুধু আপনাকে একটু উপদেশ দিতে চেয়েছি।”” ‘এ্যাই, এইটে বলেছে। মন্দ নয়।’ বললে দাড়ি গোঁপ কামানো লোক দুটোর একজন, আর অন্য জন মাথা নাড়লে সায় দিয়ে। ধনুক-পায়া লোকটা শক্ত করে ঠোঁট চেপে একটা পাথরের দিকে চেয়ে বাঁকা বাঁকা আঙুল দিয়ে তাতে টোকা দিতে লাগল।
খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সরু একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের পাতা থেকে স্ফটিকের মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ঝরিয়ে দেবার খেলায় মাতলে একজন, আর একজন শুকনো ঘাসের খোঁটা দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে চেয়ে দেখতে লাগল। বাতাস হয়ে উঠতে লাগল শুকনো আর গরম। দুপুরের সংক্ষিপ্ত ছায়া মিলিয়ে যেতে লাগল দ্রুত। থমথমে গল্পটার সঙ্গে মৃদু সঙ্গতে গুঞ্জন করে চলল সমুদ্র।
এই সাক্ষাতের পরিণতি হল লুকিনোর পক্ষে খুব খারাপ। ওর বাপ আর খুড়ো গ্রাসোর কাছ থেকে কর্জা খেয়েছিল। বেচারা বুকিনোর চেহারা হয়ে যেতে লাগল রোগা আর হতচ্ছাড়া গোছের। দাঁত কড়মড় করত সে, যার তার চোখের যে জ্বলজ্বলে ভাব দেখে মেয়েরা কাছে আসতে চাইত, সে ভাবটা নষ্ট হয়ে গেল তার। আমাকে একদিন সে বললে, “ঈস, কি বোকামির কাজই না করেছি সেদিন। নেকড়েকে কি আর কথা বলে বোঝানো যায়!” মনে মনে বুঝলাম, “লুকিনো খুন করার জন্যে তৈরি হচ্ছে।” ছোঁড়াটার জন্যে, ওদের ভালোমানুষ পরিবারটার জন্যে দুঃখ হচ্ছিল আমার। কিন্তু আমি নিজেও যে গরিব- দুনিয়ায় আপনার বলতে কেউ ছিল না, মা মারা গিয়েছিল কিছুদিন আগেই।’
বাঁকা নাক মজুরটা তার চুণের দাগ-ভরা আঙুল দিয়ে দাড়ি মোচের ওপর হাত বুলিয়ে নিলে একবার। দেখা গেল ওর বাঁ হাতের তর্জনীর ওপর মোটা ভারি মত একটা রুপোর আংটি।
‘ব্যাপারটার যদি আমি একেবারে চূড়ান্ত করে ছাড়তে পারতাম, তাহলে আমাদের লোকগুলোর উপকার হত, কিন্তু মনটা আমার একটু নরম। একদিন রাস্তায় গ্রাস্সোর দেখা পেয়ে তার পাশেপাশি হাঁটতে হাঁটতে যথাসাধ্য বিনয়ের সঙ্গে বললাম, “আপনি বড়ো নীচ আর লোভী মানুষ, আপনার সঙ্গে বাস করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। লোকে যদি কারো হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, তাহলে সে হাত ছুরি ওঠাতেও পারে কিন্তু। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, এখান থেকে চলে যান।” ও বললে, “তুমি একটি নির্বোধ, হে ছোকরা।” কিন্তু আমি জেদ করতে লাগলাম। ও হেসে বললে, “আমাকে রেহাই দেতো বাপু, কতো চাস? এক লিরা দিলে চলবে?” ব্যাপারটা অপমানের। কিন্তু রাগ চেপে রেখে আমি জেদ করলাম, “না, না, চলে যান এখান থেকে, আমি বলছি, শুনুন।” আমরা
হাঁটছিলাম গাঁ ঘেঁসাঘেঁসি করে, আমি ওর ডান দিকে। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় ও তার ছুরিটা বের করে মারলে আমাকে। বাঁ হাতের ছুরি, তাই বেশি কিছু করতে পারেনি, বুকের মধ্যে ইঞ্চি খানেক ঢুকে গিয়েছিল মাত্র। স্বভাবতই আসি মাটিতে আছড়ে ফেলে কুকুর-মার। করে লাথি মারতে লাগলাম ওকে। ও যখন মাটির ওপর যাঁকুপাঁকু করছিল তখন বললাম, “কেমন, এবার আমার পরামর্শ শুনবে আশা করি!””
দাড়ি গোঁপ কামানে। লোক দুটো কথকের দিকে অবিশ্বাসের একটা দৃষ্টি হেনে চোখ নামালে। ধনুক-পায়া লোকটা নিচু হয়ে স্যান্ডেলের চামড়ার ফিতে বাঁধতে শুরু করলে।
‘পরের দিন তখনো আমি বিছানায় শুয়ে- বন্দুকধারী সিপাহীরা এসে আমাকে নিয়ে গেল শেরিফের কাছে। শেরিফ ছিল গ্রাসোর ইয়ার। বললে, “চিরো, তুমি সৎ লোক, নিশ্চয় এ কথা অস্বীকার করবে না যে কাল রাতে তুমি গ্রাসোকে খুন করতে গিয়েছিলে।” আমি বললাম সে কথা ঠিক নয়। কিন্তু ওদের দেখবার ধরণই হল গে আলাদা। ফলে ওরা আমাকে আদালত সোপর্দ করার আগে জেলে রাখলে দু’মাস, তারপর রায় দিলে এক বছর আট মাস জেন। জজ সায়েবদের আমি বললাম, “বহুৎ আচ্ছা, কিন্তু শেষ দেখে ছাড়ব!””
পাথরগুলোর মধ্যে লুকনো একটা নতুন মদের বোতল ও বার করলে টেনে তারপর মোচের ঝোঁপের তলে বোতলটা গুঁজে দিয়ে চোঁ চোঁ করে গিললে অনেকক্ষণ। গলার রোমশ ডিমটা তৃষ্ণার্তের মতো ওঠানামা করল আর খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠল দাড়িগুলো। স্তব্ধ গম্ভীরভাবে তিন জোড়া চোখ চেয়ে চেয়ে দেখলে ওকে।
সঙ্গী মজুরদের দিকে বোতলটা এগিয়ে ভেজা দাড়িটায় হাত বুলিয়ে ও বললে, ‘এসব কথা বলতেও বিচ্ছিরি লাগে।’
গাঁয়ে যখন ফিরে এলাম, দেখি আমার সেখানে কোনো জায়গা নেই। আমাকে দেখে সবাই ভয়ে পিছিয়ে যেতে লাগল। লুকিনো বললে, সে বছর অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেছে। বেচারার একেবারে মরার দশা। মনে মনে ঠিক করলাম, “বহুৎ আচ্ছা।” দেখা করতে গেলাম গ্রাস্রোর সঙ্গে। আমাকে দেখে সে ভয়ানক আঁৎকে উঠল। বললাম, “দেখছো তো, ফিরে এসেছি। এবার চলে যাবার পালা তোমার।” ও তার রাইফেলটা তুলে নিয়ে গুলি করলে, কিন্তু বন্দুকে ছিল পাখি মারার ছররা, আর তাক করেছিল আমার পায়ের দিকে। তাতে আমি পড়ে পর্যন্ত গেলাম না। বললাম, “আমাকে খুন করেও যদি ফেলতে তবু আমি কবর থেকে উঠে এসে হানা দিতাম। মাডোনার কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তোমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব। তুমি গোঁয়ার বটে, কিন্তু আমিও কম গোঁয়ার নই।” ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল, টের পেলাম না, কখন অজান্তে ওর হাতখানা আমি ভেঙে ফেলেছি। ওকে জখম করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু প্রথম আক্রমণ ওই করেছিল। লোক জুটল ভিড় করে। ধরে নিয়ে। যাওয়া হল আমাকে। এবার সাজা হল তিন বছর ন’মাস। জেলের ওয়ার্ডেন আমার সমস্ত ঘটনা জানত। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে সে বোঝাবার চেষ্টা করলে যাতে আমি বাড়ি ফিরে না যাই। আপুলিয়ায় ওর জামাইয়ের ছিল মস্ত জমি আর আঙুর-ক্ষেত। তার কাছে কাজ জুটিয়ে দেবার কথা সে বললে। কিন্তু আমি যে তার নিয়েছি সেটা ছেড়ে দেওয়া তো আর সম্ভব নয়। তাই ফের বাড়ি গেলাম। এবার একেবারে স্থির মন করে গিয়েছিলাম যে বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করব না, কেননা ইতিমধ্যে এ শিক্ষা আমার হয়ে গেছে যে দশটা কথার মধ্যে নয়টা কথাই হল অবান্তর। শুধু একটি কথাই ওকে বলবার আছে আমার, “বেরোও এখান থেকে।” গাঁয়ে পৌঁছলাম এক রবিবারে, এবং সোজা গিয়ে হাজির হলাম গির্জার উপাসনা সভায়। গ্রাস্রোও ছিল সেখানে। আমাকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে সারা গির্জা মাথায় তুলল, “ভাই সব, ঐ লোকটা আমাকে খুন করার জন্যে এখানে এসেছে, আমার আত্মাটাকে নেবার জন্যে শয়তান পাঠিয়েছে ওকে।” ওর গায়ে যে হাত দেব, যা বলবার জন্যে এসেছি সে কথা ওকে যে বলব তার আগেই লোকজন আমাকে ঘিরে ফেললে। কিন্তু তাতে কিছু এসে গেল না। কেননা মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে জিভ আর বাঁ পাশটা ওর অবশ হয়ে গিয়েছিল পক্ষাঘাতে। সাত সপ্তাহ পরে মারা গেল গ্রাসো… এই হল গে গল্প। লোকে এই নিয়ে আমার সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী বানিয়েছে… ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব কাহিনী, কিন্তু একদন বাজে।’
লোকটা হেসে সূর্যের দিকে তাকালে। বললে: ‘যাবার সময় হয়ে গেছে…’
অন্য তিন জন উঠে দাঁড়ালো নীরবে। শিলাস্তূপের ওপরকার চবি-লাগা, মরচে ধরা ফাটলগুলোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা নাক মজুরটি বললে:
‘কাজে যাওয়া যাক…’
সূর্য আকাশের মধ্য বিন্দুতে। যতো ছায়া সব গুটিয়ে এসে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
চক্রবালের মেঘ ভার ডুবে গেছে সমুদ্রের মধ্যে। জল তার আগের চেয়েও শান্ত আর নীল।
—-সমাপ্ত
Leave a Reply