মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. তপন রায়চৌধুরীর জন্ম ৮ মে ১৯২৬ সালে বর্তমান ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশায় জন্মগ্রহণ করেন। অক্সফোর্ডের এই খ্যাতিমান শিক্ষককে উপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কীর্তিপাশার জমিদার বাড়ির এই সদস্য ১৯৪৮ সালে পরিবারের সাথে বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে তিনি অক্সফোর্ডে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। জীবনের বড় সময় অক্সপোর্ডে কাটালেও বাংলাদেশের প্রতি তার আকর্ষণ বরাবরই তীব্র ছিল। ২০০৯ সালে শেষ বার যখন বাংলাদেশে আসেন তখন স্ত্রীসহ জন্মস্থান ঝালকাঠিতে যান এবং কীর্তিপাশার জমিদার বাড়ির পুরো দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকে দান করেন। সেখানে একটি স্কুল আছে। সরেজমিনে কীর্তিপাশা গিয়ে দেখতে পেলাম বিশাল বাড়িটি সংরক্ষণের অভাবে বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে। চারদিকে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ। এই বাড়িতে একটি নাট্যমঞ্চ ছিল। জোড়াসাঁকোর জমিদার বাড়ির মতো বরিশালেও কীর্তিপাশার জমিদার বাড়ি এক সময় অতি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। বৃটিশ আমলে ঝালকাঠিকে ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ বলার পেছনে কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
২.
ড. তপন রায়চৌধুরীর লেখার মাধ্যমেই তার সঙ্গে পরিচয়। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস ও অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে তার পাণ্ডিত্য কিংবদন্তিতুল্য। সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে প্রথমে তিনি বিশেষ ভাবে পরিচিতি পেয়েছেন‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা’ নামের আনন্দময় বইটির জন্য। যেখানে বরিশালের অনেক স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। পরিচিত অনেককে বইটি পড়ার জন্য তাড়া দিয়েছিলাম। এরপর তাঁর লাইফস্কেচ জাতীয় বই ‘বাঙালনামা’ প্রকাশের পর সেটা সুধী পাঠকের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। বরিশালের কীর্তিপাশার ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ি, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সহ অনেক দিক বইটিতে আসে। ত্রিশের দশকে কক্সবাজারের অনন্য একটি বর্ণনা আছে বইটিতে। তার ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইটিতে মোঘল থেকে বুদ্ধদেব বসুর খানাপিনা দিয়ে শুরু করে আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের কথা আছে। ড. তপন রায়চৌধুরীর লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেন্স অফ হিউমার। জটিল সব বিষয়কে সহজ করে লিখে তার মধ্যে এমন সব লাইন ঢুকিয়ে দেন যে না হেসে পারা যায় না।
৩.
ড. তপন রায়চৌধুরী সর্বশেষ ঢাকায় আসেন ২০০৯ সালে। এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ স্মৃতি ট্রাস্টে বক্তব্য রাখতে তিনি ঢাকায় আসবেন এই তথ্যটি প্রথম পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. শরীফউদ্দিন আহমদের কাছ থেকে। তখন আমরা বাংলাদেশ
আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ড ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি (বারমস)এর একটি অনুষ্ঠানে ট্রেনে করে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। এই তথ্য পেয়ে আমি যখন উল্লসিত তখন অবাক করে দিয়ে ট্রেনে আমাদের এক সফরসঙ্গী জানতে চাইলেন, ‘তপন রায়চৌধুরী কে?’
শরীফ স্যার তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছুটা নীরস মুখে বললেন, ‘বিশ্বের জীবিত দশজন ইতিহাসবিদদের একজন হিসেবে ধরা হয় তাকে।’
ঢাকায় ফিরে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. সিরাজুল ইসলামকে মোটামুটি অস্থির করে ফেলি ড. তপন রায়চৌধুরীর একটি ইন্টারিভিউর ব্যবস্থা করে দিতে। সিরাজ স্যার এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আরে পাগল করে দেবো!’
৪.
অনেক মিডিয়া,পাণ্ডিত, জ্ঞানী গুণীজন ড.তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছিলেন। সিরাজ স্যার আমাদেরকে প্রথমদিন শুরুতেই ব্যবস্থা করে দেন। ড.তপন রায়চৌধুরী বিমানবন্দর থেকে ঢাকা ক্লাবে ঢুকতেই হাজির হয়ে গেলাম!
ড. তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হতে এতো অল্প সময় লাগবে ভাবি নি। আপাতদৃষ্টিতে এই গম্ভীর মানুষটি খুব সহজেই আপন করে নিলেন। তার স্ত্রী প্রতিমা রায়চৌধুরী মিষ্টি হেসে শুরুতেই বলে দিলেন, ‘সবাই আমাকে হাসিদি নামে ডাকে।
তোমরাও তাই ডেকো।’ ড. তপন রায়চৌধুরীর সর্বশেষ গবেষণার বিষয় ছিল মানুষের আচরণের ইতিহাস। এটাই ছিল আমার ইন্টারভিউর বিষয়। বিষয়টি এতো বেশি ইন্টারেস্টিং যে মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনছিলাম। তাঁর বেশ কিছু ছবি তুললাম। রুমের ভেতর এবং এক পর্যায়ে গেস্ট হাউসের বারান্দায় নিয়ে। স্যার এমনিতে হাসিখুশি থাকলেও ছবি তুলতে গেলেই গম্ভীর হয়ে যান এবং চোখ নামিয়ে রাখেন। মাত্র বিশ মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কখন দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। নিচ থেকে ফোন আসছিল বারবার। বরিশাল থেকে একটি বড় দল তপন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসে বসে আছে। একই সঙ্গে নিচে নামলাম। চলে আসার সময় তপন স্যার বললেন, ‘বিকেলে ফ্রি আছি। পারলে একবার এসো।’ তপন স্যার দেশি ভাইদের সঙ্গে তার ভাষায় খাঁটি বরিশাইল্যা স্টাইলে কথা বলা শুরু করলেন। আমরা চলে এলাম। বিকেলে ‘বাঙালনামা’ বইটি বগলদাবা করে গেলাম তপন স্যারের অটোগ্রাফের জন্য। গিয়ে দেখি রুমে এলাহী কান্ড। স্যার এবং হাসিদি তাদের সুটকেস, ব্যাগ খুলে কিছু খুঁজছেন। কারণ জানতে চাইলে জানা গেল, এশিয়াটিক সোসাইটির অনুষ্ঠানে স্যার উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বলবেন। তাঁর লেখা শেষ করবেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি ছড়া দিয়ে। কিন্তু ছড়ার বইটি আনতে ভুলে গিয়েছেন। ছড়াটিও তাঁর মনে পড়ছে না। বারবার বলছিলেন, ‘ছড়াটি ছাড়া লেখাটি অপূর্ণ থেকে যাবে।’ স্যারকে আশ্বস্ত করে বের হয়ে এলাম। অনেক ঘোরাঘুরি করে ‘অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছাড়সমগ্র’ কিনে নিয়ে গেলাম তার কাছে। বইটি পেয়ে তারা দুজন এমন ভাবেই আমাকে ধন্যবাদ দেয়া শুরু করলেন যে আমি খুবই বিব্রতবোধ করছিলাম। একটি ছড়া যে কতোটা কাছে নিয়ে এসেছিল এরপর স্যারের সঙ্গে অন্তত সাত দফায় দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলার সময় তা বুঝতে পেরেছি। অন্নদাশঙ্কর রায়কে মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ দিলাম দয়া করে ছড়াটি লেখার জন্য!
৫.
এশিয়াটিক সোসাইটির ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ স্মৃতি ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে অসাধারণ একটি লেকচার দেন ড. তপন রায়চৌধুরী। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের গুণী মানুষে সেদিন জাদুঘর অডিটোরিয়াম পূর্ণ ছিল। অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদের ছেলে ও বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ঢাকা ক্লাব, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রাঙ্গন এবং পরবর্তী সময় লেখক নূরজাহান বোসের ধানমন্ডির বাসায় স্যারের সঙ্গে আলাপে অনেক অজানা কথা জানার সুযোগ হয়েছে। এটি ছিল খুবই অসাধারণ অনুভূতি। অক্সফোর্ডে নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ, মানুষের আচরণ কীভাবে বদলে যায় তার ব্যাখ্যা, খাওয়া দাওয়াসহ নানান বিষয় তিনি সরস ভাবে বলে গিয়েছেন। মুগ্ধ শ্রোতা হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। স্যার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগের দিন নূরজাহান বোসের বাসায় যখন গেলাম তখন হাসিদি তাদের অক্সফোর্ড ও কলকাতার ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার লিখে দিলেন যোগযোযোগ রাখার জন্য। আমাদের বললেন, এরপর যখন ঢাকায় আসবো তখন তোমাদের ওখানটায় যাবো। বিষয়টা সামাজিকতা ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলাম যখন অক্সফোর্ডে পৌঁছে তিনি নিজেই ফোন করেছিলেন। রুটসে ড.তপন রায়চৌধুরীর ওপর লেখাটি অনেকেই পছন্দ করেছিলেন। লেখক নূরজাহান বোস অক্সফোর্ডে স্যারের বাসায় রুটসের কপি নিয়ে যাওয়ার কথা জানান আমাকে।
৬.
বিস্ময়কর হলেও সত্য, দশ বছর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ‘বাঙ্গালনামা’ বইটি বারবার হাতে নিয়ে পড়ছিলাম। যতোবার বইটি খুলছি ততোবারই তপন স্যারের অটোগ্রাফের দিকে চোখ যেতেই মুচকি হাসি চলে আসে। ২৬ নভেম্বর ২০১৪ বুধবার তিনি অক্সফোর্ডে নিজ বাড়িতে মারা যান। মনে পড়ছিল ২০০৯ সালে ২১ থেকে ২৮ নভেম্বরের এই সময়টাতেই তিনি ঢাকায় ছিলেন।
অনন্য এই মানুষটির সঙ্গে কিছু অসাধারণ মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ তখন পেয়েছিলাম।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply