শিল্প ও অবকাঠামোগত সৌন্দর্যের দিক থেকে এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি হলো মালয়েশিয়া। দেশটির বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপগুলোর অধিকাংশই অবস্থান করছে রাজধানী কুয়ালালামপুরে। সীমান্তজুড়ে তিতিওয়াংসা পর্বতমালা এবং মালাক্কা প্রণালী দ্বারা পরিবেষ্টিত এই দেশের বৃহত্তম নগরীটি একটি বিশেষ স্থানের অধিকারী। এখানকার প্রতিটি স্থাপনায় আভিজাত্য ও সৃজনশীলতার এক মনোমুগ্ধকর মেলবন্ধন রয়েছে। দিনের আলো নিভে গেলেও শহরের জনাকীর্ণ রাস্তাগুলো আলোকসজ্জায় ভরিয়ে রাখে গোটা কুয়ালালামপুরকে। চলুন, এই কুয়ালালামপুর শহরের বিশ্বখ্যাত স্থাপনা, শপিং সেন্টার এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান
পেট্রোনাস টাওয়ার্স
১ হাজার ৪৮৩ ফুট উচ্চতার ৮৮-তলা এই দালান জোড়ার আরেক নাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত দালান দুটি আলাদাভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনার তালিকা থেকে অনেক আগেই নেমে গেছে। তবে দুটোকে একসঙ্গে বিবেচনা করা হলে এটি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে উচু টুইন টাওয়ার হিসেবে রয়ে গেছে।
এর ৪১ ও ৪২তম তলায় দুটি টাওয়ারকে যুক্ত করেছে একটি ডাবল ডেকার স্কাইব্রিজ যা বিশ্বের সর্বোচ্চ দোতলা সেতুর রেকর্ড ধারণ করে আছে।
৮৬তম তলায় রয়েছে অবজারভেশন ডেক যেখান থেকে শহরের প্যানোরামিক দৃশ্যে চোখে পড়ে আরও অনেক পর্যটন স্থান। এমনকি লিফ্ট করে উপরে ওঠা ও নামার সময়টা এক দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতির সঞ্চার করে।
কেএলসিসি পার্ক
স্থাপনার নামসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুয়ালালামপুরকে উপস্থাপনের নিমিত্তে সংক্ষেপে কেএল ব্যবহার করা হয়। সে অনুসারে কেএলসিসি বলতে বোঝানো হয় কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার।
টুইন টাওয়ারের ধাতব অবয়বে সবুজায়নের অলঙ্করণ দিতেই এর ঠিক নিচে রয়েছে কেএলসিসি পার্ক। এর প্রধান আকর্ষণ ১০ হাজার বর্গ মিটারের লেক সিম্ফনি যেখানে রয়েছে বেশ কিছু কৃত্রিম ফোরায়া। সবচেয়ে উচু ফোয়ারাটির উচ্চতা ২৮০ মিটার। লেকের বাইরে পার্কের স্থলভাগগুলোর বিভিন্ন অংশেও দেওয়া হয়েছে সঙ্গীতের তালে তালে ফোয়ারা-সজ্জা। জগিংয়ের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের রাবারজাত উপাদানের তৈরি ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফুটপাত। পার্কের পশ্চিম দিকে রয়েছে পাবলিক পুলসহ শিশুদের জন্য একটি খেলার মাঠ।
কুয়ালালামপুর টাওয়ার (কেএল টাওয়ার)
৩৬০ ডিগ্রি কোণ করে চারপাশের কুয়ালালামপুরকে দেখতে হলে আরহণ করতে হবে শহরের এই সর্বোচ্চ ভিউ পয়েন্টে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ারগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে থাকা এই দালানে লিফ্ট দিয়ে পর্যবেক্ষণ ডেক পর্যন্ত উঠতে ৫৪ সেকেন্ড সময় নেয়। আর নেমে আসতে সময় লাগে ৫২ সেকেন্ড। কেএল টাওয়ারের অন্যান্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ এবং কালচারাল ভিলেজ। আর স্কাই বক্সের গ্লাস কিউবের ভেতরে দাড়িয়ে নিচের শহর দেখার দৃশ্যটি রীতিমতো রোমহর্ষক।
কুয়ালালামপুর বার্ড পার্ক (কেএল বার্ড পার্ক)
২০ দশমিক ৯একর প্রশস্ত এই পাবলিক এভিয়ারিটি বিশ্বের বৃহত্তম বার্ড পার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই পার্ক ভ্রমণে একসঙ্গে আরও তিনটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়।
সেগুলো হচ্ছে- পের্ডানা বোটানিক্যাল গার্ডেন, কেএল বাটারফ্লাই পার্ক এবং রয়্যাল মালয়েশিয়ান পুলিশ মিউজিয়াম।
বার্ড পার্ক ২০০ টিরও বেশি প্রজাতির ৩ হাজারেরও বেশি পাখির আশ্রয়স্থল। এগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশই স্থানীয় পাখি। বাকি ১০ শতাংশ আনা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া,চীন,হল্যান্ড,ইন্দোনেশিয়া,নিউ গিনি, তানজানিয়া এবং থাইল্যান্ডের থেকে।
অ্যাকোরিয়া কেএলসিসি
শহরের প্রাণকেন্দ্রে কেএল কনভেনশন সেন্টারের ঠিক নীচেই অবস্থিত এই বিশাল অ্যাকোয়ারিয়ামটি। পানির নিচে ৩০০ ফুট গভীরতার টানেলসহ ৬০ হাজার বর্গফুট বিস্তৃত জায়গাটি রীতিমত বলা যায় সামুদ্রিক সাফারি পার্ক। দেশি-বিদেশি সব মিলিয়ে এখানে ২৫০টিরও বেশি প্রজাতির স্থল ও জলচর প্রাণী রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি। দর্শনার্থীদের অ্যাকোরিয়া যাত্রা শুরু হয় কুয়াশায় ঢাকা উচ্চ ভূমিতে। তারপর রেইনফরেস্ট এবং ম্যানগ্রোভ হয়ে ক্রমশ এগিয়ে চলে। অতঃপর নদীর মধ্য দিয়ে গিয়ে যাত্রা শেষ হয় প্রবাল প্রাচীরের গভীর নীল সমুদ্রে।
কুয়ালালামপুরের জনপ্রিয় যত শপিংমল
কেবল কেনাকাটা নয়;শপিংমলে ঘুরে বেড়ানোতে যারা আনন্দ খুঁজে পান, তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা হচ্ছে কুয়ালালামপুর। এর কারণ শুধু আকাশচুম্বী উচ্চতা আর স্থাপত্য নকশাই নয়। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো যখন সব একসঙ্গে দেখা যায় তখন চোখ রীতিমতো বিস্ফারিত হওয়ার যোগাড় হয়।
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলা যেতে পারে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের পাশেই অবস্থিত ৬ তলা সুরিয়া কেএলসিসির কথা। এর ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় স্থান পেয়েছে আর্ট গ্যালারি,আন্ডারওয়াটার অ্যাকোয়ারিয়াম,বিজ্ঞান আবিষ্কার কেন্দ্র,১২ স্ক্রীন সিনেমা এবং কনসার্ট হল। মার্কেট অংশের অধিকাংশই বিদেশি বিলাসবহুল পণ্যে ভর্তি।
শপিং ও চিত্তবিনোদনের জেলা বুকিত বিন্তাংয়ের প্রথম উৎকর্ষ হচ্ছে ৭ তলা বিশিষ্ট প্যাভিলিয়ন কেএল। এখানে ক্রেতাদের জন্য বিশ্রাম,স্পা ও সেলুনের ব্যবস্থা রয়েছে বিউটি হল-এ। সেন্টার কোর্টে সমস্ত বড় মাপের ইভেন্ট এবং প্রচারণামূর্লক কার্যক্রমগুলো সংঘটিত হয়। মালয়েশিয়া ও জাপানের উৎসব এবং কেএল ফ্যাশন উইকয়ের মতো ইভেন্টগুলো এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
বইপ্রেমিদের জন্য সুপরিচিত একটি ভবন মিড ভ্যালি শহরের মিড ভ্যালি মেগামল। তবে শুধু বইয়ের দোকান-ই নয় এর ৫ তলা ভবন জুড়ে রয়েছে ৪৩০ টি দেশি-বিদেশি বিপণী,সিনেমা হল এবং বোলিং অ্যালি। পেটালিং জায়া এবং কুয়ালালামপুরের প্রবেশমুখে অবস্থিত এই মলটি মিড ভ্যালি এম্পোরিয়ামের একটি অংশ। এম্পোরিয়ামের গার্ডেন মলটি একটি সেতু দিয়ে মিড ভ্যালি মেগামলের সঙ্গে সংযুক্ত।
মাল্টি পার্পাস ভবন বার্জায়া টাইম্স স্কয়ার শপিংমলের জন্য বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত। বুকিত বিন্তাংয়ে অবস্থিত ৬৬৬ ফুট উচ্চতার এই স্থাপনাটিও একটি টুইন টাওয়ার্স। ৭৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় নির্মিত ৪৮ তলা ভবনের মধ্যে ১৯ তলা শপিং কমপ্লেক্স যার মধ্যে রয়েছে ১ হাজারেরও বেশি খুচরা দোকান। এছাড়াও রয়েছে হোটেল,কন্ডোমিনিয়াম,ইন্ডোর থিম পার্ক, বিভিন্ন বাণিজ্যিক অফিস এবং খাবারের আউটলেট।
কুয়ালালামপুরের ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাবার
শহরটির স্থানীয় খাবার ও এর রন্ধনশৈলীতে যেমন রয়েছে নিজস্বতা তেমনি রয়েছে একাধিক ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ।
একদম সকালের নাস্তা থেকে শুরু করলে অনায়াসেই চলে আসে নাসি লেমাকের প্রসঙ্গ। নারকেল দুধের সঙ্গে সিদ্ধ ভাতের আয়োজনকে সুগন্ধিযুক্ত করা হয় পোলাও বা পায়েস পাতা দিয়ে। এর উপরে সাজানো আয়োজনে খুব সাধারণ পদ হলো ভাজা অ্যাঙ্কোভি মাছ। এর সঙ্গে প্রয়োজন মতো দেওয়া হয় চিনাবাদাম,শসার সালাদ,সিদ্ধ ডিম,মরিচ এবং চিংড়ি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই তল্লাটে এলে পর্যটকরা প্রথমেই যে খাবারটি খুঁজে বেড়ান তা হচ্ছে- সাতে। বিভিন্ন ধরনের সসের সঙ্গে মিশিয়ে গরম কয়লার উপর মাংসকে ভাজা হতে থাকে। এভাবে খুব সাবধানে হালকা পোড়া অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে মূলত মুরগি, গরু বা ভেড়ার মাংসই বেশি ব্যবহার করা হয়। আর সসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় হালকা মশলাদার চিনাবাদাম।
উৎপত্তিটা চীনে হলেও চার কুয়ে তেওয়ের এখানকার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া খাবারগুলোর একটি। এটি হচ্ছে সয়া ও ঝিনুকের সস দিয়ে বানানো এক ধরনের নুডলস। একাধিক সসের মিশ্রণই এই খাবারের মূল বিশেষত্ব। পূর্ণাঙ্গ ডিশে রূপ দেওয়ার জন্য এতে যোগ করা হয় ডিম,রসুন,শিম, লুপ চিওং নামের এক ধরনের মিষ্টি। যারা সামুদ্রিক খাবারের প্রতি আলাদা ঝোঁক রয়েছে তাদের জন্য চিংড়ি অথবা স্কুইডও সংযোজন করা হয়।
এই ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো ছাড়াও পর্যটকদের নিয়মিত ভ্রমণভোজে যুক্ত থাকে বারবিকিউ চিকেন উইংস এবং ফিশ হেডকারী।
বাংলাদেশ থেকে কুয়ালালামপুর যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়ালালামপুর বেশ কিছু বিমান নিয়মিত যাতায়াত করে। এই ননস্টপ যাত্রায় সময় লাগে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। কেএল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্যাক্সি ক্যাবে করে শহর পর্যন্ত যেতে হয়।
পরিশিষ্ট
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর ভ্রমণ মানেই এক চোখ ধাঁধানো সভ্যতার বিস্তৃত জনপদে বিচরণ করা। একদিকে পেট্রোনাস টাওয়ার এবং কেএল টাওয়ারের চোখ কপালে তোলা উচ্চতা, অন্যদিকে কেএলসিসি পার্ক এবং অ্যাকুয়ারিয়ার বিস্ময় এক চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতার পরিচায়ক। সুরিয়া কেএলসিসি এবং বুকিত বিন্তাং ও পেটালিং জায়ার শপিংমলগুলো যেন ধারণ করে রয়েছে গোটা শহরের স্পন্দন। স্থানীয় সংস্কৃতির সব সুর ঐকতানে বাজে যখন অংশ নেওয়া হয় নাসি লেমাক, চার কোয়া তেও এবং সাতে-এর ভোজে। সব মিলিয়ে কুয়ালালামপুর অবিরাম গতিতে বিকশিত শিল্পের দৃশ্যমান দিগন্তের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ইউএনবি নিউজ
Leave a Reply