হারুন উর রশীদ স্বপন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷
সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সারের প্রশ্ন, ‘‘যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের কোনো প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করলো না কেন?”
রবিবার ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি নিয়ে সব আসামিকে খালাসের রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার একটি আদালত গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
সবাইকে খালাসের রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় ২০১১ সালে আসামি মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে সস্পুরক চার্জশিট দেওয়া হয়। ওই চার্জশিটের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত বিচার করেন, যা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এজন্য বিচারিক আদালতের রায়ও বেআইনি ও অবৈধ।”
পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরো বলেন, ‘‘এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ দেখেছেন, কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন, এই মর্মে কোনো এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে, তাদের টর্চার করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।”
হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘‘মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো এভিডেনশিয়াল মূল্য নেই। এটি জোর করে নেয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা যথাযথভাবে যাচাই করা হয়নি।”
আর আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘‘একইসঙ্গে মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার নজির নেই।”
আদালত বললেন, ‘‘দ্বিতীয় জবানবন্দি তিনি যেটি করেছিলেন, সেটিও পরে তিনি প্রত্যাহার করেন। এজন্য এ জবানবন্দির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এর ফলে হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেন।”
ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও তিন শতাধিক নারী ও পুরুষ আহত হন। সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ওই হামলায় অল্পের জন্য রক্ষা পান। তবে তিনি তার কানে প্রচণ্ড আঘাত পান।
বিএনপি সরকারেরর সময় ওই ঘটনায় তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করার চেষ্টা করা হলেও আওয়ামী লীগের মামলা না নিয়ে পুলিশ নিজে মামলা করে। পরে ২০০৫ সালে জজ মিয়া নামে একজনের জবানবন্দির ভিত্তিতে মামলার তদন্ত এগোয়। কিন্তু জজ মিয়া পরে তার কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি আদায়ের কথা বললে মামলাটি নাটকীয় মোড় নেয়। ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের সময় মামলটির তদন্ত নতুনভাবে শুরু হয়।
২০০৮ সালের ১১ই জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অধিকতর তদন্ত শেষে সম্পূরক চার্জশিটে বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয় সিআডি।
‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’
“রবিবার সব আসামিকে খালাস দেয়ার পর বাংলাদেশের সব মিডিয়া আসামিদের স্বজন বা তাদের অনুসারীদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। কিন্তু যারা ভিকটিম, যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের পরিবারের কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাইনি। সংবাদমাধ্যম কি তাদের প্রতিক্রিয়া পায়নি? তারা কেন তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলো না। এটা দুঃখজনক,” বলেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া আশরাফ কায়সার।
তার কথা, “শুরু থেকেই এই মামলাটিতে রাজনীতি ড্রাইভিং সিটে আর বিচার বিভাগ ব্যাক সিটে ছিল। আমরা বিএনপির আমলে জজ মিয়া নাটক দেখেছিলাম হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দিতে। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে। সেটিও দেখেছি একটা গয়রহ রায়। কারণ, অপরাধভেদে বিচার যেভাবে সুনির্দিষ্টভাবে হয়, সেটি তখন হয়নি।”
তিনি বলেন, “গতকালকে (রবিবার) যে রায়টি হলো, সেটি আরো একটি প্রশ্নের জন্ম দিলো। তাহলে কি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এরকম একটি রায় হলো কিনা দেখুন ২৪ জন মানুষ মারা গেছে । তিনশ’রও অধিক মানুষ আহত হয়েছে। তাদেরকে কারা নিহত ও আহত করলেন, গ্রেনেডগুলো কারা মেরেছে রায়ের মধ্যে কিন্তু সুনির্দিষ্টাভাবে সেই কথাগুলো নেই। রায়ে বলা হয়েছে কেউ গ্রেনেডের উৎস বলতে পারেনি। ছুঁড়তে দেখেনি কাউকে। কিন্তু ঘটনাটি তো ঘটেছে। একজন বিরোধী দলীয় নেত্রীর সমাবেশে এটা হয়েছে। এটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। এটা একটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গতকালের রায় আমাদের আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করলো এই মামলাটির চলমান স্থিতি বুঝতে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, “আদালত বলেছেন চার্জশিট ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু এটা বলে আদালত যেটা করতে পারতেন, আসামিদের ফের রিমান্ডে পাঠানো বা মামলার পুনঃতদন্ত এসব ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া। কিন্তু আদালত এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি। ফলে এখন মনে হচ্ছে, ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না। আদালত ঘটনাটাকে ধরে ফের তদন্তের কথা না বলায় এখানে আইনগত একটি ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়েছে। ”
“আমরা একটা সিনেমা দেখি ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ সেই সিনেমারই প্রতিফলন দেখি আমরা এই রায়ে। ২১ আগষ্ট আসলেই কিছু ঘটেছিলো কিনা সেটি নিয়েই এখন প্রশ্ন তোলার মতো অবস্থা হয়েছে। ফলে আইনগতভাবে এটা সঠিক হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি,” বলেন তিনি।
তার কথা, “ফৌজদারি মামলায় সরকার হলো বাদী। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে এখন অ্যাটর্নি জেনারেলের আপিল অথবা আইনগত প্রক্রিয়া যা আছে তা শুরু করা উচিত।”
আর এই মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম সরকার বলেন,” আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। আমরা পুর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আপিল করবো।”
‘আপনারা যা ভালো মনে করেন’
একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে এখনো বেঁচে আছেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মাহবুবা পারভীন। স্বামী নেই। দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন সাভারে তার বাবার বাড়িতে। তার শরীরে গ্রেনেডের এক হাজার ৮০০ স্প্লিন্টার এখনো আছে। সারাজীবন তাকে শরীরে এই স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াতে হবে। তিনি বলেন, “আমার জীবনটা আসলে শেষ হয়ে গেছে। শরীরে সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি৷ রাতে ঘুমাতে পারি না। কোনো চিকিৎসাও এখন আর করাতে পারি না। মাসে ১০ হাজার করে টাকা পেতাম সরকারের কাছ থেকে। আগস্ট মাস থেকে সেই টাকা দেয়াও বন্ধ হয়ে গেছে।”
Leave a Reply