ম্যাকসিম গোর্কী
একুশ
তিনি সাইপ্রেস গাছের ছায়ায় একটি পাথরের বেঞ্চিতে বসেছিলেন। তাঁকে অত্যন্ত ক্ষীণ, ক্ষুদ্র, এবং বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। তবু যেন তাঁকে ইহুদিদের দেবতার মতো লাগে। তিনি ঈষৎ ক্লান্ত হয়ে পাখীর গানের সংগে সুর মিলিয়ে শিস দিয়ে নিজেকে একটু হালকা করার চেষ্ট। করছেন। ঘন পাতার অন্ধকারে পাখী ডাকছে: তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ ক্ষুদ্র চক্ষু দু’টোকে পাকিয়ে একবার উপরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলেন, তারপর ছোটো ছেলের মতো ঠোঁট দু’টোকে কুঁচকে অপটুভাবে শিস দিতে লাগলেন।
“ঐ একরত্তি প্রাণী, কিন্তু কী ভীষণ রাগ। ভয়ানক চটে গেছে, কি পাখী বলোতো?”
‘স্যাফিঞ্চ’। আমি তাঁকে স্যাফিঞ্চ পাখীর গুণাগুণের কথা বললাম। বললাম এর চরিত্রগত ঈর্ষার দিকটা।
তিনি বললেন “সারা জীবন ধরে একটা মাত্র গান গাইলো। তবু কিনা তার হিংসে। অথচ মানুষ, যার হৃদয়ে হাজারো গান রয়েছে, সে যখন হিংসে করে, তখন হয় তার নিন্দে। এ কি উচিত?” তিনি চিন্তাজড়িত সুরে কথাগুলি বললেন, যেন নিজেকে প্রশ্ন করছেন।
“এমন অনেক মুহূর্ত আসে পুরুষের, যখন সে মেয়েদের এমন অনেক কথাই বলে ফেলে, যেগুলো মেয়েদের জানা উচিত নয়। পুরুষেরা বলে আর ভুলে যায়, কিন্তু মেয়েরা ভোলে না। সম্ভবত ঈর্ষা আসে নিজের আত্মাকে অধঃপতিত করার, -হীন হবার, হাস্যাপদ হবার ভীতি থেকে। তাই না? যে-মেয়ে পুরুষকে পুরুষের…. দিয়ে ধ’রে রাখে, সে বিপজ্জনক নয়। কিন্তু সেই মেয়ে হোলো বিপজ্জনক, যে ধ’রে রাখে পুরুষকে পুরুষের আত্মা দিয়ে…।”
এবার আমি যখন তাঁর ‘ক্রুয়েৎসার সোনাটা’র উল্লেখ ক’রে তাঁর কথার স্বতঃবিরুদ্ধতা দেখিয়ে দিলাম, তখন তাঁর গুল্ফ ভেদ ক’রে মৃদু হাসির আলোক ঝিলিক দিয়ে গেল। তিনি বললেন:
“কিন্তু আমি তো স্যাফিঞ্চ পাখী নই।”
একদিন সন্ধ্যায় বেড়াতে বেড়াতে অকস্মাৎ তিনি ব’লে উঠলেন:
“মানুষ ভূমিকম্প, মহামারী, ব্যাধির বিভীষিকা এবং আত্মার সকল প্রকার যন্ত্রণা সত্ত্বেও বেঁচে থাকে। কিন্তু তার সব সময়ের সব চেয়ে বড়ো বেদনা হোলো, হয়েছে, এবং হবে-তার শোয়ার ঘরের ট্র্যাজেডিটা।”
Leave a Reply