স্বদেশ রায়
জুলাই মাসের তুলনায় বাংলাদেশে এখন মাংস খাওয়া ও উৎপাদনের পরিমান অর্ধেকে নেমে গেছে। ৪ ডিসেম্বর বনিক বার্তা এ নিউজটি করেছে। এবং বিবিসি তাদের ওয়েব সাইটে বিভিন্ন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উল্লেখ করে যে নিউজ আইটেমটি করে- তারও লিড এই নিউজটি। সংবাদ মাধ্যম হিসেবে আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকার শীর্ষে এখনও বিবিসি। এমনকি ইরাক যুদ্ধের সময় তাদের নিউজের কিছুটা পরিবর্তনের পরেও। তাই সে হিসেবে বিচার করতে গেলে ৪ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়ার মধ্যে এ মুহূর্তে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিউজটি করে বর্নিক বার্তা।
এছাড়া সম্প্রতি গোলাম মওলা রনি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে যা বলেন, তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এমনই, তিনি সম্প্রতি কাঁচা বাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে মাছ আছে যথেষ্ট। তবে একদিকে মাছের দাম যেমন বেশি অন্যদিকে ক্রেতা কম। গোলাম মওলা রণির বক্তব্য’র মূল ফোকাস ছিলো- এই ক্রেতা কম থাকায় মাছ বিক্রেতাদের বেশি দামে মাছ কিনে এনে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। যার ফলে দ্রুতই ওই ব্যবসায়ীরা তাদের ছোট পুঁজি হারাবে। কিন্তু গোলাম মওলা রণির এই অবজারভেশানের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক হলো, মাছের বাজারে ক্রেতা কম। অর্থাৎ কম মানুষ মাছ কিনছে। যা থেকে বোঝা যায় মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমান কমে গেছে।
গোলাম মওলা রণির ওই বক্তব্য প্রচারের কয়েকদিন পরে বিডি নিউজ ডট কমে( bdnews.com) একটা নিউজ প্রকাশিত হয়, মানুষ মাছ কিনতে না পেরে মাছের কাঁটা কিনছে। ওই নিজউে বাস্তবে বলা হয়, বড় বড় হোটেল গুলোতে পাঙাস মাছের মূল অংশটুকু প্রসেস করে বিক্রি করার পরে লেফট ওভার হিসেবে মাছের যে মাথা এবং কাঁটা থাকে- সেটা ২৫ টাকা দরে মানুষ কিনছে। অর্থাৎ কিছু মানুষ মাছ খেতে না পেরে মাছের কাঁটা খাচ্ছে।
এছাড়া অনলাইন শপ গুলোতে দেখা যাচ্ছে কাঁচা ঘি অর্থাৎ কম পাকের ঘি ১৬’শ টাকা কেজি। ঘি খাবার পরিমান কেমন কমেছে সে নিউজ কোথাও দেখিনি। তবে মাস ছয়েক আগে প্রকার ভেদে এটার দাম ছিলো এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ বারো’শ টাকা কেজি। ১৬’শ টাকা কেজি ঘি মধ্যবিত্তের জন্যে খুব সহজ নয়।
উপরের নিউজ গুলো থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে, সাধারণ মানুষের প্রোটিন খাওয়া কমে গেছে।
অন্যদিকে শর্করা জাতীয় খাদ্যের ভেতর সব থেকে কম দামী খাবার ছিলো গোল আলু। এর ডায়মন্ড আলু বাজারে ৮২ টাকা কেজি। হলান্ড জাতীয় বলে পরিচিত আলুর জাতটি ১’শ টাকা কেজি। চালের দাম এখনও অবশ্য আলুর থেকে কিছুটা কম আছে।
মাছ, মাংস ও দুধ জাতীয় খাদ্য’র প্রোটিন। আলূ, চাল জাতীয় খাদ্যে থেকে আসা শর্করা ছাড়াও সাধারণত আমাদের দেশের মানুষ সবজি খেয়ে থাকে। সবজির দাম কিছুদিন আগে যেভাবে আকাশ ছুঁয়েছিলো সেখান থেকে কিছুটা কমেছে। সবজিতে সব ধরনের মিনারেল ও ভিটামিন থাকায় একটা ব্যালান্স ফুড তৈরি করতে সবজি অনিবার্য যে কোন ডিসে।
কিন্তু বাজারের এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে সমাজের একটি বিশাল শ্রেনীর মানুষ তাদের সন্তানদের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, শর্করা ও মিনারেল এবং ভিটামিন জোগান দিতে পারবে না।
আর এই প্রোটিন, শর্করা ও মিনারেল শুধু শরীরের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য দরকার তা নয়- মানুষের মস্তিষ্কের পুষ্টি- অর্থাত মেধা বৃদ্ধির জনেও সব থেকে প্রয়োজনীয়। প্রোটিন, শর্করা ও মিনারেল এর সাপ্লাই যদি শরীরে কম থাকে তাহলে ব্রেইনের কোষগুলো সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। যার ফলে চিন্তা শক্তি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই দুর্বল হয়ে পড়ে- এটাও বিজ্ঞান ভিত্তিক।
যে কারণে আগে দেখা যেত সরকারের উচ্চপদের কর্মকর্তা, সামন্ত, শিল্পপতি বা বড় ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানরা স্কুল থেকেই পড়াশুনায় ভালো থাকতো। এবং উচ্চ শিক্ষায়ও তারা ভালো ফল করে রাষ্ট্র ও সমাজের ভালো স্থানগুলো দখল করতো। এমনকি অনেকটা প্রবাদের মতোই আছে -ঘি খাওয়া মাথার সঙ্গে সহজে পাল্লা দেয়া যায় না। এই ঘি এখানে প্রতিকী অর্থে ব্যবহৃত হতো। ঘি যেহেতু দুধের স্বর অর্থাৎওপরের অংশ থেকে তৈরি হয় তাই ঘিকে প্রতীক ধরে বলা হতো ওরা সমাজের ওপরের অংশের সন্তান। সমাজের ওপরের অংশে অবশ্য খাদ্য ছাড়া আরো কিছু বিষয় থাকে- যেমন পরিবার কেন্দ্রিক শিক্ষা ও জীবন চর্যা। পরিবারে ধারাবাহিক শিক্ষা থাকায় পরিবারটিই একটা ইউনিভারসিটি হয়ে ওঠে। সেখানে পিতা, মাতা, ভাই, বোন বা পিতামহ, মাতামহ’র কাছ থেকে যেমন বিশ্ব সাহিত্য, বিশ্ব ইতিহাস (তাই সে রাজনীতি থেকে বিজ্ঞান ও সিভিলাইজেশানের ইতিহাস) এগুলো কৈশোরের মধ্যেই ওই সব সন্তানরা পেয়ে যায়। যেমন সাবেক সচিবদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ ভাই (কবি) মুহিত ভাই ও মোকাম্মেল ভাই এর ঘনিষ্টতা পেয়েছি অনেক বেশি। তাদের কথার ভেতর দিয়েই বোঝা যায়, তাদের মেধার ভান্ডারটি এসেছে তাদের পরিবার থেকে। তাই তারা কর্মজীবনেও অন্য ধরনের উজ্জল। অর্থাত তাদের ঘি খাওয়া মাথা।
পূর্ববাংলার সমাজে এমন একটি অংশ হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ আমলের আগের থেকেই ছিলো এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে গত ৭৫ বছরে আরো একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে।
এরা সংখ্যায় কমে হলেও এরা পারিবারিক পুষ্টি ও খাদ্য পুষ্টির জোরে একটি মেধাকোটা সুবিধা সব সময়ই ভোগ করে। যেমন পাকিস্তান আমলেও এই পূর্ব বাংলার হিন্দু সাধারণ সামন্ত, ভূস্বামী বা ডিএম, ব্যবসায়ী,বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ডাক্তার পরিবারের ঠাকুরমা অর্থাত দাদীরাও ইংরেজি ফার্স্টবুক যেমন মুখস্ত বলতে পারতেন, যে কোন ইংরেজি বানান ভুল হলেই ধরিয়ে দিতেন- তেমনি বাংলা ভাষার বাইরে সংস্কৃত ও পার্সিও তারা জানতেন। আর এ পরিবার গুলো রিফিউজি হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া ও শরনার্থী হয়ে সর্বস্ব হারানোর আগ অবধি কিন্তু তাদের সন্তানদের জন্যে এক ধরনের মেধা কোটা তৈরি করতো।
গত ৭৫ বছরে নতুন একটি শ্রেণী যে এই ভূখন্ডে গড়ে উঠেছে, যাদের কারো কারো পরিবারের বই থেকে শুরু করে পেইন্টিং কালেকশান ঈষর্ণীয় যে কোন রুচিবানের জন্যে। এই সব পরিবারের সন্তানরাও কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দেশে বা বিদেশে অতীতের ওই সব পরিবারের সন্তানের মতো একটা মেধা কোটা ভোগ করবে।
এ অবস্থায় যদি দেশে সাধারণ মানুষের সন্তানের জন্যে প্রোটিন, শর্করা ও মিনারেলের প্রয়োজনীয় জোগান না থাকে তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা একটি বিশেষ কোটার কাছে হেরে যাবে। আর এই হেরে যাওয়াই কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল লক্ষ্যটি হেরে যাওয়া।
কারণ এই ডিসেম্বরে আমরা যদি অতীতের দিকে চোখ রাখি তাহলে দেখতে পাই, এই দেশের জন্যে যারা যুদ্ধ করেছিলো তারা বেশিভাগ ছিলো নিম্ম মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আর সাধারণ কৃষক ও শ্রমিক। এই সাধারণ কৃষক ও শ্রমিক যুদ্ধ করেছিলো তাদের সন্তানের জন্যে একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার লক্ষ্যে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির চক্ররথে যদি মেধাবী সৃষ্টি একটি বিশেষ শ্রেণীতে আটকে যায়- তাহলে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য শুধু ব্যর্থ হবে না- দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্ত পরিবারের সন্তানরা একটি লম্বা সময়ের জন্য বৈষম্যে ঢুকে যাবে।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply