সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫৭ অপরাহ্ন

গরিবের ডাক্তার

  • Update Time : শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায় ডা. বসন্ত কুমার রায়ের তিনতলা বাড়ির নিচতলা সব সময় ব্যস্ত থাকে শত মানুষের উপস্থিতিতে। শিশু থেকে প্রবীণ নানা বয়সের মানুষ এসে ভিড় জমান এখানে। কোনো কোনো সরকারি হসপিটালেও আউটডোরে এতো ভিড় দেখা যায় না। একজন ডাক্তার অসীম ধৈর্য নিয়ে কখনো মিষ্টি হেসে, কখনো কপট রাগ দেখিয়ে পরম মমতায় প্রত্যেকের চিকিৎসা করে চলেছেন। একজন সাধক যেভাবে সাধনা করেন ডা. বসন্ত কুমার রায় গত পঞ্চান্ন বছর ধরে সেভাবে রোগী দেখে চলেছেন। এমবিবিএস ডিগ্রি নেয়ার পরই জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে নিয়েছিলেন:

এক. স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করবেন।

দুই. তিনি গরিব মানুষের চিকিৎসা করবেন।

তিন. রোগী ধনী বা গরিব যাই হোন না কেন- তার লক্ষ্য থাকবে সবচেয়ে কম খরচে যেন রোগী সুস্থ হতে পারেন।

বৃহত্তর দিনাজপুরের দেবীগঞ্জ যা এখন পঞ্চগড়ের একটি থানা সেখানে সুন্দরদীঘি গ্রামে জন্মেছেন ডা. বসন্ত কুমার রায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবা মধুসূদন রায় এবং মা অহল্যা বালা রায় ছেলেকে পড়িয়েছেন প্রথমে দেবীগঞ্জ এনএনএইচ স্কুলে। তারপর রংপুরে কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে। সে সময় ডাক্তারি পড়ার চেয়ে দ্রুত এমএ পাশ করে চাকরি করতে আগ্রহী ছিলেন অনেকে। রাজশাহী মেডিক্যালে তার সহপাঠী পঞ্চাশ জনের মতো ছিলেন। তাদের দশজনই শুরুতেই মেডিক্যাল কলেজ ছেড়ে চলে যান।

১৯৫৯ সালে রাজশাহী মেডিক্যালে তখন দুই ব্যাচ মিলে একশ শিক্ষার্থীও ছিলেন না। কোনো নিজস্ব ছাত্রাবাস ছিল না। দুটো ভাড়া বাড়িতে আল হেলাল ছাত্রাবাসে মুসলিম আর মাইনরিটি ছাত্রাবাসে সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরা থাকতেন। শাসক শ্রেণী নানা ভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করলেও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি। এতো বছর পরেও আজাদ কাশ্মির থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আসা তাদের সহপাঠী আমির হোসেন খানকে ভুলতে পারেন নি বসন্ত কুমার রায়।

১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাশ করে ডা. বসন্ত কুমার রায় চলে যান গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু তিনি ঘরে বসে থাকবেন এটা তার বাবা মধুসূদন রায়ের পছন্দ ছিল না। তিনি প্রথমে ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে পাঠালেন ঠাকুরগাঁয়ে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকা হয় নি ডা. বসন্ত কুমার রায়ের। তিনি আবার বাড়ি ফিরে যান। এবার বাবা বলেন দিনাজপুর শহরে কিছু করা যায় কিনা ভেবে দেখতে। দিনাজপুরে কয়েকজন আত্মীয় থাকলেও তাদের সাহায্য না নিয়ে ডা. বসন্ত কুমার রায় নিজে কিছু করার মানসিকতা নিয়ে ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে দিনাজপুর শহরে আসেন। ১৯৬৭ সালের মার্চে দিনাজপুর শহরের কালিতলায় পুরানো একটি দোকানকে মেরামত করে শুরু করেন তার নতুন জীবন। একজন কমপাউন্ডার রাখেন তিনি। সে সময় প্রাইভেট প্র্যাকটিসে একজন ডাক্তার কমপক্ষে পাঁচ টাকা ভিজিট নিতেন। তিনি শুরু করলেন এক টাকা দিয়ে। যেহেতু শুরু থেকেই তার লক্ষ্য গরিব রোগীদের চিকিৎসা করার।

কেন তিনি রোগী হিসেবে গরিবদের অগ্রাধিকার দেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. বসন্ত কুমার রায় বলেন, ‘আমি গরিব মানুষের মধ্যেই বড় হয়েছি। আমাদের পরিবার হয়তো কিছুটা সচ্ছল ছিল। ছেলেবেলা থেকেই চারপাশে গরিব মানুষদের অভাব, কষ্ট দেখেছি। তখন থেকেই আমার ভাবনা ছিল তাদের জন্য কিছু করার। আর যে কোনো রোগই হলো একজন মানুষের জন্য বিপদ। আমার চেষ্টায় একজন মানুষ যদি বিপদমুক্ত হন তাহলে আমার ভালো লাগবে।’

ডা. বসন্ত কুমার রায় কৃতজ্ঞতার সাথে এখনো স্মরণ করেন ডা. এ কে খান, জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানসহ তার সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে। ডা. এ কে খান তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যখন একজন রোগী আসবে তখন তার হাঁটা চলা, বসা, মুখের অভিব্যক্তি সবই লক্ষ করতে হবে। রোগীকে সঠিক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে শতকরা ৮০ ভাগ চিকিৎসা। বাকি ২০ ভাগের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা বা ওষুধ দিতে হবে।

কথাটি তিনি শুরু থেকেই মেনে চলেন। এতো বছরের অভিজ্ঞতায় এখন রোগী বা তার অ্যাটেনডেন্টকে দেখেই তিনি বুঝে ফেলেন কে কেমন সমস্যা নিয়ে এসেছেন, কার আর্থিক অবস্থা কী। অনেক সময় রোগীরা কিছু বলার আগেই ফ্রি চিকিৎসা শুধু নয়, হাতে প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনা পয়সায় তুলে দেন। রোগীরা কৃতজ্ঞতায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

মানুষের সেবা করে আনন্দ পান স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত ডা. বসন্ত কুমার রায়। করোনার কারণে সামাজিক চাপে কিছুদিন চেম্বার বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সে সময়টা ছিল তার জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর। তিনি নিয়মিত রেলবাজার হাটে যান। সেখানে অনেক মানুষ আসেন। তারা তাদের সমস্যার কথা বলেন। সেখানেও তিনি রোগীদের পরামর্শ দেন। চার প্রজন্মের চিকিৎসা করছেন তিনি। স্থানীয় ভাষায় লোকজন বলেন ‘বাপ, বেটা, নাতি, নাতির ঘরে পুতি’ সবাই তার কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন।

রোগীরা যখন এসে বলেন, ‘বেটা, তুমি মারা গেলে আমরা কোথায় যাবো?’ এরচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট তার কাছে আর কিছুই না।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে ডা. বসন্ত কুমার রায় তার আন্তরিক সেবা দিয়েছেন। বাবার পরামর্শে তিনি দেশ ছাড়েন। সীমান্ত পাড়ি দিতে সাহায্য করবেন বলে এক প্রতারক তাদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। সামান্য সঞ্চয় নিয়ে তিনি সীমানা পাড়ি দেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে রামগঞ্জ হেলথ কমপ্লেক্সে ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রথমে তিনি ছিলেন করেতোয়া ক্যাম্পে। এটি ছিল শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ির মাঝামাঝি। প্রথমদিকে সেখানে ক্ষুধা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ডায়রিয়া, কলেরা জাতীয় রোগে অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে। তার চোখের সামনেই সাত-আটশ শিশুকে মারা যেতে দেখেছেন। ধীরে ধীরে ক্যাম্পে কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়তে থাকে। এরপর তিনি দায়িত্ব পান শিলিগুড়ির বলরাম শরণার্থী শিবিরে। সেখানে প্রায় ৪০ হাজার শরণার্থী ছিলেন। তিনিসহ ডাক্তার তিনজন। বাকি দু’জন পঞ্চগড়ের ডা. আবদুর রাজ্জাক ও নীলফামারীর ডা. বিনোদ সাহা। ২৪ জন হেলথ অ্যাসিসট্যান্ট। ১৫ টাকা করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ডাক্তারদের প্রতিদিনের সম্মানী দেয়া হতো। একটি পরিত্যক্ত বাড়িকে হসপিটালে রূপ দেন ডা. বসন্ত কুমার রায় ও তার সঙ্গীরা। তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি (ভি.ভি গিরি) তাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে আশ^াস দেন, শিগগিরই তারা দেশে ফিরতে পারবেন। এসব কথা তখন তাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হতো।

শরণার্থী শিবিরের ওষুধ, কম্বলসহ শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল ডা. বসন্ত কুমার রায়ের ওপর। যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের বলা হয় শিবির থেকে শতকরা অন্তত ৮০ ভাগ শরণার্থী না যাওয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সব দায়িত্ব ও মালামাল বুঝিয়ে দিয়ে তারা শিবির ছেড়েছেন ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ফিরে আসার আগে তারা চাঁদা তুলে শিলিগুড়ির সিভিল সার্জন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য বিদায়ী ডিনারের আয়োজন করেন। অতিথিরা সেখানে তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন একথা আজো তার মনে আনন্দের জন্ম দেয়।

স্ত্রী কল্পনা রায়, চার বছরের ছেলে উৎপল কুমার রায় ও সাড়ে তিন মাসের মেয়ে মালবিকা রায়কে নিয়ে যখন ডা. বসন্ত কুমার রায় দিনাজপুরে ফিরে আসেন তখন তার পকেটে ছিল মাত্র ৮০০ টাকা। কালিতলায় তার সে সময়ের একতলা বাড়িটি বিহারিরা দখল করে রেখেছিল। সেটি ফেরত পেলেন। পরিবার নিয়ে একটি ভাঙা চৌকিতে রাত কাটিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলেন পথচলা।

৫৫ বছরের কর্মজীবনে সততাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন ডা. বসন্ত কুমার রায়। কথা হচ্ছিল সততা, চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি, চিকিৎসার নামে কমিশন বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জনের অসৎ উপায় বিষয়ে। ডা. বসন্ত কুমার রায় বলেন, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে সততা আসে। আমি যে জন্মগ্রহণ করেছি তারপর থেকেই মৃত্যু আমার পেছন পেছন হাঁটছে। কখন আমার মৃত্যু হবে আমি জানি না। ঈশ্বর শুধু শুধু আমাকে পৃথিবীতে পাঠান নি। তিনি কিছু কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমি সে কাজই করার চেষ্টা করছি। এতে করে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকা যাবে। এতে করে এই জীবনে না হলেও আরেক জীবনে তার সান্নিধ্য পাবো।’

স্ত্রী, ভাই, ভাইদের পরিবার, নিজের এক ছেলে তিন মেয়ে নাতি নাতনিদের নিয়ে ডা. বসন্ত কুমার রায় খুশি। ছোট ভাই তরুণ কুমার রায় একজন ডাক্তার ও তার যোগ্য উত্তরসূরী। ডা. তরুণ কুমার রায়ও ৪০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখেন। ডা. বসন্ত কুমার রায়ের তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে সুস্মিতা রায় ও সুদীপ্তা রায় ডাক্তার। মেজো মেয়ে সুস্মিতা রায়ের স্বামী উদয় শঙ্কর রায়ও ডাক্তার। তারা বসন্ত কুমার রায়ের ধারা বজায় রাখবেন এটা তিনি আশা করেন।

ডা. বসন্ত কুমার রায়ের কাছে কখনো মনে হয় নি জীবনে অনেক টাকা প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, ‘টাকা থাকলেই সুখ আসে না। আমাদের একদিন সব ছেড়ে যেতে হবে। এক টুকরো সাদা কাপড়ে আমাদের ঢেকে দেয়া হবে। এটাই পরিণতি। তাই যেটুকু প্রয়োজন তা হয়ে গেলে লাগাম টানাটা খুব জরুরি।’

৮৫ বছর বয়সে এসেও সুস্থতার রহস্য জানতে চাইলে ডা. বসন্ত কুমার রায় জানান তিনি সময় মেনে সব কাজ করেন। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। বিছানায় হালকা ইয়োগা করেন। তারপর নাস্তা করে চলে যান ছাদের বাগানে। চার শতাধিক ফুল ফলের গাছে ভরা বাগানে কাজ করতে করতে তার মন ভালো হয়ে যায়। যে কোনো দুচিন্তা দূর করতে তিনি বাগানে চলে যান। যখন একটি ফুল ফুটতে দেখেন বা একটি ডালিম বা পেয়ারা বড় হতে দেখেন তখন তার সব ক্লান্তি বিষণ্ণতা দূর হয়ে যায়।

প্রতিদিন সকালে তিনি কলা, কাজু বাদাম খান। বছরের ৩৬৫ দিনই তার খাবারের তালিকায় শাক থাকে। ছোট মাছ খান। মাংস খান না বলেই চলে। ভাত খুব কম খান।

ভার্চুয়াল যোগাযোগের এই মহামারীতেও তিনি সবার সাথে দেখা করতে ভালোবাসেন। তিনি মনে করেন, মানুষকে আপন করে নেয়াটা সাধ্যের বাইরের কোনো বিষয় নয়। যে কেউ চেষ্টা করলেই এটা সম্ভব। আর এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বাবা মাকে যে দেখবে না বয়সকালে তার সন্তানও তাকে দেখবে না। অহংকার ত্যাগ করে কাজ করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতা পরিবর্তন করা।

সাক্ষাৎকার শেষে বিদায়ের সময় মিষ্টি হেসে ডা. বসন্ত কুমার রায় বলেন, ‘আমার জন্য আর্শীবাদ কোরো, যেন কাজ করতে করতেই আমার মৃত্যু হয়!’

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024