সন্ন্যাসী ঠাকুর
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে উঠিয়াছি। বয়স বোধহয় ছয়-সাত বৎসর হইবে। আমাদের বাড়ির পশ্চিম ধারে নদীর তীরে শ্মশানঘাট। এখানে একখানা টিনের আটচালা ঘর ছিল। মরা পোড়াইতে যাহারা শ্মশানে আসিত-রৌদ্র বৃষ্টির সময় তাহারা সেখানে আসিয়া আশ্রয় লইত।
সেদিন আমি আর আমার বড় ভাই শ্মশানের পথে বাড়ি ফিরিতেছি, দেখিলাম গেরুয়া-পোশাক পরা একজন সন্ন্যাসী সেই ঘরের মধ্যে আধশোয়া অবস্থায় হাত ঢেলান দিয়া বসিয়া আছেন। কৌতূহলী-দৃষ্টি মেলিয়া ঘরের জানালা দিয়া আমরা তাঁহাকে দেখিতে লাগিলাম। আমার মনে হইল কুমারবাড়ি হইতে কে যেন সদ্য-রং-করা একখানা মাটির মূর্তি সেখানে রাখিয়া গিয়াছে। তাঁহার গায়ের বর্ণে কে যেন কাঁচা-সোনা মাখিয়া দিয়াছে। মাথার সুদীর্ঘ কেশ-বিন্যাস, আজানুলম্বিত বাহু আর মুখভরা ঘনকৃষ্ণ শ্মশ্রুতে দেব-জ্যোতি ঠিকরিয়া বাহির হইতেছে। আমরা অবাক হইয়া তাঁহাকে দেখিতেছি। তিনিও দুই-একবার আমাদিগকে চাহিয়া দেখিলেন, তারপর হাতের ইশারায় আমাদিগকে নিকটে ডাকিলেন।
আমরা কাছে গেলে অতি স্নেহের সঙ্গে তিনি আমাদের নাম, বাড়িঘর, পিতামাতার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। এইসব কথার উত্তর দিয়া আমার সঙ্কোচ কাটিয়া গেল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি ঘরবাড়ি ছাড়িয়া এখানে শ্মশানে আসিয়া রহিয়াছেন কেন?”
তিনি উত্তর করিলেন, “আমার যে ঘরবাড়ি নাই।” আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি গেরুয়া-কাপড় পরিয়াছেন কেন?” তিনি হাসিয়া উত্তর করিলেন, “গেরুয়া-কাপড় না পরিলে তোমার মতো খোকা কি আমার দিকে চাহিয়া দেখিত?”
এইভাবে প্রথম দিনের আলাপে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে অনেক চোখা চোখা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম। বড় ভাই আকারে-ইঙ্গিতে আমাকে বারণ করিতেছিলেন; কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কেন যেন জানি না, সবগুলি প্রশ্নেই আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরকে ঠকাইতে চাহিয়াছিলাম। সেই আদিকালের মানুষেরই স্বভাব। অপরিচিত কেহ সংস্পর্শে আসিলে প্রথমে তাহাকে আক্রমণ করিবার মনোবৃত্তির মতো। তিনি আমার সবগুলি প্রশ্নের আক্রমণ এমন সস্নেহ উত্তরে কাটাইলেন যে, ধীরে ধীরে আমি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইতে লাগিলাম।
সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করিয়া বাড়ি ফিরিলাম। ফিরিবার পথে আমি আর আমার বড় ভাই দুইজনেই একমত হইলাম, সন্ন্যাসী ঠাকুর বেশ ভালো লোক। কাল আবার আমরা তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিব।
পরদিন আমি একাই সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। চারিদিকে বসিয়া শহরের বহু গণ্যমান্য লোক তাঁহার সঙ্গে ধর্মকথা আলোচনা করিতেছিলেন। এত লোকের মধ্যে বসিয়াও তিনি বালক বলিয়া আমাকে অবহেলা করিলেন না। তিনি আমাকে সংজেহে কাছে ডাকিয়া লইয়া বসাইলেন। তারপর আবার ধর্মকথা আরম্ভ করিলেন। সেসব বড় বড় দার্শনিক তত্ত্বপূর্ণ-কথা আমি কি বুঝি? আমি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। এইসব ধর্মকথা প্রসঙ্গে তিনি যখন তাঁহার সন্ন্যাসজীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনীগুলি বলিয়া যাইতে লাগিলেন তাহা বংশীধ্বনি-আকৃষ্ট বন্য হরিণের মতো আমার বালকমনকে আকৃষ্ট করিবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। গৃহস্থজীবনে তিনি নাটরের পাগলা মহারাজার বন্ধু ছিলেন। তাঁহার পিতা মহারাজার ম্যানেজার অথবা অন্য কোনো উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁহার নাম ছিল দুর্গাচরণ চক্রবর্তী।
চলবে…
Leave a Reply