সন্ন্যাসী ঠাকুর
ধানের মরসুমে আমার যত্নে রোপিত ফুলগাছগুলির উপর দিন-মজুরেরা খড়ের আঁটি ফেলিয়া সেগুলিকে ধ্বংস করিত। আমার মনে ক্ষোভের অন্ত ছিল না। আজ সন্ন্যাসী ঠাকুরের বাগানে কাজ করিয়া ফুলগাছ রোপনের শখ যেন আবার আমাকে পাইয়া বসিল। এ বাগান তো সন্ন্যাসী ঠাকুরের নয়। এ বাগান আমার, তোমার সকলের-সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভক্তদের। বাগান ভরিয়া অপরাজিতা, মল্লিকা, যুঁই, চামেলি, বেলি, সন্ধ্যামালতী, জবা, টগর, গন্ধরাজ, নানা বর্ণের গাঁদা প্রভৃতি ফুলগুলি যখন ফুটিত তখন আমার মনে হইত আমি নিজেই যেন ফুটিয়া উঠিয়া ইহাদের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছি। শহর হইতে ভক্তেরা আসিয়া বলিত, “বাবাজি! আপনার আঙিনায় আসিলে আর যাইতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় এই ফুলগাছগুলির সঙ্গে চিরকাল এখানে থাকি।”
সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে দেখাইয়া বলিতেন, “এই বাগানের জন্য যা কিছু প্রশংসা তাহা এই বালকটির প্রাপ্য।” শুনিয়া গৌরবে আমার বুক ভরিয়া যাইত।
এইভাবে ঘন ঘন সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া হিন্দু দেব-দেবতার পৌরাণিক কাহিনীগুলি আমি জানিয়া ফেলিলাম। আমার প্রথম জীবনে মুনসুর মৌলবি সাহেবের কাছে যে ইসলামিক শিক্ষা পাইয়াছিলাম তাহা ভুলিয়া গেলাম। কালী, মহাদেব, দুর্গা, শিব প্রভৃতি হিন্দু দেবদেবীতে বিশ্বাস করিতে লাগিলাম। পুরাকালে কে কিভাবে তপস্যা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন সেইসব কাহিনী শুনিয়া বিশ্বাস করিতে লাগিলাম।
তখন স্কুলে নামমাত্র যাই। আর অধিকাংশ সময়ই সন্ন্যাসী ঠাকুরের এখানে কাটাই। বাড়ি হইতে অভিভাবকেরা আমার জন্য ভাবিত হইলেন। আমার পিতা সন্তানদের প্রতি কখনও কঠোর ছিলেন না। আমরা কোনো গুরুতর অন্যায় করিলে যদিও কখনও কখনও তিনি কিল থাপড়টা মারিতেন কিন্তু সেই মারে তেমন ব্যথা ছিল না।
আমার শাস্তির ভার লইলেন আমার বড় ভাই। নিজে তিনি সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়াই পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়াছেন। আমার পিতার শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি আর স্কুলে ফিরিয়া গেলেন না। মাঝে মাঝে পিতার বাক্স ভাঙিয়া তাঁহার সেই কষ্টে উপার্জিত টাকা-পয়সা লইয়া তিনি বাড়ি হইতে উধাও হইতেন। তাহার পর কিছুদিন পরে আবার ফিরিয়া আসিতেন। এই বড় ভাই শিশুকাল হইতেই আমার প্রতি খুবই নিষ্ঠুর ছিলেন। তাঁহার জিনিসপত্র, বই, কলম প্রভৃতির উপর আমার ছিল মস্ত বড় আকর্ষণ। তাঁহার অবর্তমানে আমি সেগুলি নাড়িয়াচাড়িয়া তছনছ করিতাম। অপটু হাতে লিখিতে যাইয়া পেন্সিলের শিস ভাঙিয়া ফেলিতাম। এজন্য তিনি আমাকে বেদম প্রহার করিতেন। তাই শৈশবকাল হইতেই তাঁকে আমি দুই চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। সেই বড় ভাই সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া লইয়া আমাকে শাসন করিবার ভার লইলেন।
ইয়োমার পিতা বাড়িতে থাকিলে তাঁহার বেদম প্রহারের হাত হইতে আমাকে তিনি রক্ষা করিতেন। কিন্তু পিতার অবর্তমানে যখন তিনি আমাকে ঠেঙাইতে আরম্ভ করিতেন, কেহই আমার সাহায্যে আসিত না।
তিনি আমাকে মারিতেন আর বলিতেন, ‘বল, আর সন্ন্যাসীর কাছে যাইকি না?” আমি কিছুতেই তাহা বলিতাম না। যা মুখে আসে অকথ্য ভাষায় তাঁহাকে গালি পাড়িতাম। ইহান্তে তাঁহার রাগ আরও বাড়িয়া যাইত। তিনি আরও জোরে জোরে আমাকে মারিতেন। উড়াতে হয়রান হইয়া আমাকে ছাড়িয়া দিতেন।
তবু তিনি আমাকে সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া বন্ধ করিতে পারিলেন না। সন্ন্যাসী ঠাকুরের ওখানে আমি ধ্রুব প্রহ্লাদের গল্প শুনিয়াছিলাম। কৃষ্ণভক্তির জন্য প্রহ্লাদকে তাঁহার পিতা হক্তিপদতলে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন, তবু তাঁহার কৃষ্ণভক্তি টলে নাই। প্রহ্লাদের তুলনায় আমার বড় ভাইয়ের মার আমার কাছে তো পুষ্পাঘাত। আমি নীরবে তাঁহার মার সহ্য করিতাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আগের মতোই যাইতাম। এই অত্যাচারের কথা তাঁহাকে বলিতাম না।
চলবে…
Leave a Reply