সন্ন্যাসী ঠাকুর
শুধু বড় ভাই-এর অত্যাচারই নয়-আমি নিজেও স্বেচ্ছায় আমার জীবনের উপর আরও অনেক অত্যাচার ডাকিয়া আনিলাম। তখন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম সুযোগ পাইলেই আমি একদিন বাড়িঘর ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইয়া হিমালয় পর্বতে যাইয়া তপস্যা করিব। সন্ন্যাসী ঠাকুরের নিকট শুনিয়াছিলাম, সেই বন্ধুর হিমালয়-পথে কোনো খাদ্য পাওয়া যায় না। একরকমের গাছের বড় বড় পাতা পাওয়া যায়। তাহাই চিমটা দিয়া আগুনের উপর ধরিয়া সামান্য সিদ্ধ করিয়া খাইতে হয়। একদিন ঠিক করিয়া ফেলিলাম, আর আমি মাছ-মাংস খাইব না। ধীরে ধীরে ভাতও ছাড়িয়া দিব। শুধুমাত্র শাক-পাতা খাইয়া জীবনধারণ করিব। আমার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া বাড়ির কেহই কোনো গুরুত্ব দিলেন না। তাঁহাদের ধারণা হইল দুই-একদিন মাছ-মাংস না খাইয়াই আমার প্রতিজ্ঞা টুটিয়া যাইবে। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা টুটিল না। আমাদের বাড়িতে রোজ তো আর মাছ-মাংস রান্না হইত না। প্রায় অধিকাংশ দিনই শুধু ডাল-ভাত অথবা শাক-ভাত খাইতে হইত। যেদিন মাছ অথবা মাংস রান্না হইত সেদিন আমি লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ-ভর্তা করিয়া ভাত খাইতাম।
প্রতিদিন একবেলাও যাহাদের ভাত জোটে না সেই গরিব মুসলমান চাষীদের রোজা রাখার মতো এই মাছ-মাংস না খাওয়াটা আমার পক্ষে কিছুই অসুবিধা বলিয়া মনে হইত না। সন্ন্যাসীর আশ্রমে যেসব গোঁড়া-হিন্দু আসিত তাহারা আমার মুখে পেঁয়াজ ও রসুনের গন্ধ পাইত। এজন্য মাঝে মাঝে সমালোচনাও করিত। ইহা তো স্বাভাবিক। যেদিন পেঁয়াজ-মরিচ ভর্তা করিয়া ভাত খাইতাম সেদিন মুখ হইতে কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ বাহির হইত। একজন গোঁড়া-হিন্দু একদিন এই কথা সন্ন্যাসী ঠাকুরকে বলিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি পেঁয়াজ-রসুন খাওয়া ছাড়িয়া দিতে পার?”
আমি বলিলাম, “নিশ্চয়ই পারি। আজ হইতে আর আমি পেঁয়াজ-রসুন স্পর্শও করিব না।”
এইবারই আমার সত্যকার আত্মপীড়ন আরম্ভ হইল। আমাদের মুসলমান পরিবারে যে যে তরকারি রান্না হয় তাহার প্রত্যেকটিতেই পেঁয়াজ রসুন দেওয়া হয়। আমার মায়ের একলার সংসার। একটার বেশি তরকারি তিনি কখনও রাঁধিবার সময় পাইতেন না। আর সময় থাকিলেও আমাদের সামর্থ্য ছিল না। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন মা বিনা পেঁয়াজ-রসুনে আমাকে একটু ডাল রাঁধিয়া দিতেন। অন্যান্য দিনে আমি শুধু নুন-মরিচ দিয়াই ভাত খাইতাম।
দুধ-ঘিয়ের কথা তো আসেই না। এইভাবে খাইতে খাইতে আমি শুকাইয়া কাঠ হইয়া উঠিলাম। কিন্তু আমার সংকল্প হইতে বিচ্যুত হইলাম না। ইহার পরে আমি আরও কঠোরতা আরম্ভ করিলাম। যে-ঘরে আমার দাদা দানু মোল্লা থাকিতেন সেই ঘর পরিষ্কার করিয়া লেপিয়া-পুঁছিয়া সেখানে করিলাম আমার সাধনার স্থান। সকালে বিকালে আসন করিয়া বসিয়া ঘরের বেড়ায় কাগজে আঁকা একটি কালো ফোঁটার দিকে চাহিয়া থাকিতাম। কিন্তু সেই শিশুবয়সের চঞ্চলমন। কালো ফোঁটার দিকে চাহিয়া চাহিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের ওখানে কোন দিন কি ঘটনা ঘটিয়াছে এইসব চিন্তা করিতাম। বহুদিন ভালো কিছু খাই না। সেই ধ্যানাসনে বসিয়া ভালো ভালো খাবার জিনিসের কথাও মনে আসিত। আগে আমি আমার পিতার সঙ্গে এক বিছানায় শয়ন করিতাম। এই সাধনা আরম্ভ করিয়া আমি একা সেই ঘরে শয়ন করিতে লাগিলাম।
মাঝে মাঝে আমি পদ্মাসনে বসিয়া নাভিমূলের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন, এইভাবে দেখিতে দেখিতে তুমি নাভিমূলে একটি চন্দ্রের মতো উজ্জ্বল বিন্দু দেখিতে পাইবে। কিন্তু নাভির মূলে চাহিয়া চাহিয়াও আমার মন নানা কল্পনায় উধাও হইয়া যাইত। বিশেষ করিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনীর পথে পথে আমার মন ঘুরিয়া বেড়াইত।
চলবে…
Leave a Reply