বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:০৭ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯২)

  • Update Time : শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

সন্ন্যাসী ঠাকুর

আমি জলধর দাদাকে বলিলাম, “আমি সাধনা করিতে কোনো বিভূতিই দেখিতে পাই না।” তিনি প্রশ্ন করিলেন, “তবে যে বাবা বলেন তুই সাধন-পথে অনেক অগ্রসর হইয়াছিস? সাধনা করিতে করিতে অনেক কিছু দেখিতে পাস?” আমি বলিলাম, “তিনি এইসব কেন বলেন আমি জানি না। আমি আপনাকে সত্য কথাই বলিতেছি।” জলধর দাদা আমাকে ছাড়িয়া দিলেন।

সন্ন্যাসী ঠাকুর মাঝে মাঝে তাঁর ভক্তদের নিমন্ত্রণে শহরে যাইতেন। সেদিন আশ্রমের পাহারার ভার থাকিত আমার উপর। কোনো কোনো দিন বাগানের ফুলগাছের চারা বা ডাল আনিবার জন্য জলধর দাদার বাড়ি যাইতাম। একদিন বাগান হইতে এ-গাছের ও-গাছের ডাল কাটিয়া জলধর দাদা আমার হাতে দিতেছেন এমন সময় অন্দরমহল হইতে আমার ডাক পড়িল। ভিতরে যাইয়া দেখি, দুর্গা-প্রতিমার মতো একটি মহিলা বারান্দায় বসিয়া আছেন। লাল চওড়া পাড়ের সাদা ধবধবে কাপড় পরনে, কপালভরা লাল সিন্দুর। তিনি বলিলেন, “আমি তোর রানীদিদি। এইখানে বস্।” এই বলিয়া রানীদিদি আমাকে একখানা পিঁড়ি আগাইয়া দিলেন। আমি দুই হাত জোড় করিয়া রানীদিদিকে নমস্কার করিলাম।

এই সেই রানীদিদি! যাঁহার প্রশংসা সন্ন্যাসী ঠাকুর পঞ্চমুখে করেন, যিনি কতরকমের মিষ্টি তৈরি করিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে পাঠান। রানীদিদি খুঁটিয়া খুঁটিয়া প্রশ্ন করিয়া আমার নিকট হইতে সন্ন্যাসী ঠাকুরের সমস্ত খবর জানিয়া লইলেন। সেইসব প্রশ্ন কতই তুচ্ছ বলিয়া আজ মনে হয়। কিন্তু যে তাঁহাকে ভালোবাসে, ভক্তি করে, তাঁহার কাছে এইসব তুচ্ছ ঘটনাই যে কত কাব্যময় হইয়া উঠে! “বাবা কোন সময় ঘুম হইতে উঠেন? কোথায় স্নান করিতে যান, কখন যান?

বাবার বাগানখানা কত বড়? কি কি ফুলগাছ সেখানে লাগানো হইয়াছে, কোন কোন গাছে ফুল ফুটিয়াছে?” এমনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এই অবরোধবাসিনী মহিলার শ্মশানঘাটে আসিয়া সবকিছু দেখিয়া যাইবার ক্ষমতা নাই। আমার নিকট হইতে সবকিছু জানিয়া হয়তো এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের আশ্রমের পারিপার্শ্বিকতার একটি ছবি মনে মনে আঁকিয়া লইলেন। গল্প করিতে করিতে এক বাটি মিষ্টান্ন আনিয়া বলিলেন, “ভাই। জান তো আমরা হিন্দু। আমাদের থালাবাটিতে তোমাকে খাইতে দিলে আমার ভাশুরেরা অসন্তুষ্ট হইবেন।

তুমি কিছু মনে করিও না। আমি তোমার হাতে একটু একটু করিয়া মিষ্টান্ন দেই, তুমি খাইতে থাক।” দিদি একটু একটু করিয়া মিষ্টান্ন আমার হাতে দিয়া আমাকে যত্নের সঙ্গে খাওয়াইলেন। তারপর আমাকে অঞ্জলি করিয়া হাত পাতা শিখাইয়া সেই হাতের উপর শূন্য হইতে জল ঢালিয়া আমাকে পান করাইলেন। অনভ্যস্ত হাতে এরূপ জলপান করিতে আমার জামার কিছুটা ভিজিয়া গেল। সেই জলের দু’এক ফোঁটা দিদির সুন্দর ধবধবে শাড়িতেও লাগিল। দিদি এদিকে ওদিকে চাহিয়া তাহা শাড়ির অপর ভাঁজে লুকাইয়া ফেলিলেন, পাছে বাড়ির আর কেহ দেখিয়া ফেলেন। বিদায়ের সময় দিদি বার-বার করিয়া বলিয়া দিলেন, “তুমি ভাই। যখনই অবসর পাইবে আমার সঙ্গে আসিয়া দেখা করিও।”

ফুলগাছের কয়েকটি ডাল বগলে করিয়া শ্মশানঘাটে ফিরিলাম। দিদির সঙ্গে পরিচিত হইয়া মনে হইল কি যেন অমূল্য রত্ন কুড়াইয়া পাইলাম। তারই আনন্দে সারাপথ নাচিতে নাচিতে আর গান গাহিতে গাহিতে চলিলাম।

 

চলবে…

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024