নিজস্ব প্রতিবেদক
আমরা হাওরকে কোনভাবেই ধ্বংস হতে দিতে পারি না। হাওর-জলাভূমি সুরক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আমাদের মানসিকতার এবং কাঠামোগত দুটোরই পরিবর্তন প্রয়োজনের কথা বলেছেন জাতীয় হাওর সংলাপে অংশগ্রহণকারী বক্তারা। সেই সাথে জরুরী ভিত্তিতে হাওর ইজারা বন্ধের দাবি উঠেছে এ সংলাপে।
হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার সুরক্ষায় এএলআরডি, বারসিক, এবং বেলা’র সমন্বিত উদ্যোগে ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে ঢাকাস্থ সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জাতীয় হাওর সংলাপ-২০২৪’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জাতীয় হাওর সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব ফরিদা আখতার। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এবং এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরপি)’র নির্বাহী পরিচালক জনাব শামসুল হুদা। এতে দুটো প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। হাওরের কৃষি-মৎস্য-পরিবেশ ও জীবনজীবিকা বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বারসিক-এর পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস এবং হাওর জলাভূমি, নীতিমালা, আইন ও ন্যায়বিচার বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক সানজিদা খান রিপা।
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)-এর পরিচালক পাভেল পার্থের সঞ্চালনায় জাতীয় সংলাপে বক্তারা হাওরের প্রাণ- প্রকৃতি সুরক্ষায় জনসচেতনতা, সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন এবং এই আইনের কার্যকর প্রয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বারসিক-এর পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাসের উপস্থাপনায় জানা গেছে, হাওর উপযোগী কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে হাওরাঞ্চলে কোম্পানী নির্ভর রাসায়নিক কৃষি, বাণিজ্যিকি ইজারাদার এদের দৌড়াত্ম বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওরাঞ্চলে ২৩০ প্রজাতির দেশি মাছের বৈচিত্র্য ক্রমশ কমছে। হাওর-জলাভূমি ইজারা দিয়ে বাণিজ্যিক মৎস্য খাতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও অভয়াশ্রম গুলো বিনষ্ট হচ্ছে। হাওরে এখন আউশ, আমন ধানের চাষ হয় না। শুধুমাত্র বোরো উফশী ধানের প্রাধান্য। সেটাও আবার পাহাড়ি ঢলে বিনষ্ট হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের স্রোতের সাথে আসা বালু দিয়ে কৃষি জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওরাঞ্চলের মাছের অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র সোয়াম্প ফরেস্ট (জলাভূমি বন) আমরা বিনষ্ট করেছি।
এএলআরডি ও বেলার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত খসড়া “বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২২” নিয়ে পর্যালোচনা ও সুপারিশ তুলে ধরেন সানজিদা খান রিপা, প্রোগ্রাম ম্যানেজার এএলআরডি। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত খসড়া আইনের প্রথম সংস্করণ তৈরি হয় ৫ এপ্রিল ২০২৩ এবং দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩। প্রথম সংস্করণে ৬ টি অধ্যায়ের অধীন ২৯ টি ধারা উল্লেখ ছিলো। পরবর্তীতে সেটা কমিয়ে ৫ টি অধ্যায় ও ২৪ টি ধারা রাখা হয়েছে। খসড়া আইনের সাধারণ কার্যাবলীতে বেশ কিছু ইতিবাচক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুনির্দিষ্ট কাজগুলো কি হবে, কে কিভাবে করবে, এবং না করলে কি হবে- এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট জবাব নেই। অথচ, বিপুল ব্যয়ের এককালীন প্রকল্প ও কার্যক্রমের উল্লেখ করা হয়েছে আইনে। চতুর্থ অধ্যায়ে অপরাধ, দণ্ড ও বিচারের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক বা তার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তাকে মামলা করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ অপরাধের বিচারের জন্য মামলা দায়ের এর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বা নাগরিকের অভিযোগ আমলে নেয়া হবে না- যা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। হাওর ও জলাভূমি এলাকার তথ্য সংগ্রহ, ডাটাবেজ তৈরি, মানচিত্র তৈরি, তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের কথা বলা হলেও সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান কাজটি করবে এবং জলাভূমি এলাকার কি ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হবে সেগুলো আইনে বলা হয়নি। এই আইন বা বিধির আওতায় সরল বিশ্বাসে কৃত কাজের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্তৃপক্ষ বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এটিও সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ-২৭)-এর পরিপন্থী।
ড. হালিম দাদ খান বলেন, হাওর এমন একটা জিনিস যা ধ্বংস হয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। হাওর ইজারা প্রথা বাতিল করতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। জমিদারি প্রথা যদি বাতিল হতে পারে, সেখানে বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে ইজারা প্রথা থাকতে পারে না। ইজারা দেওয়া বন্ধ হলেই দেশীয় প্রজাতির মাছ আবার ফিরে আসবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব ফরিদা আখতার বলেন, তিন লাখ ৬২ হাজার ৭৩০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে হাওর বেষ্টিত ৭ টি জেলায়। আমি যখন হাওর বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা খুজঁতে গেলাম তখন দেখলাম এটি সম্পূর্ণভাবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। হাওরের সুরক্ষায় শুধুমাত্র পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ই নয়, এর সাথে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে হাওর রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। একসময় আমন ধানই ছিলো মূল ধান। এখন মোট ধান উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ হলো বোরো ধান যার ১৮ শতাংশ হাওরে উৎপাদিত হয়। নদী খনন না করার কারণে পাহাড়ি ঢলে আসা পানি হাওরগুলো ধারণ করতে পারে না। হাওর সুরক্ষা একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। হাওরের ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যুতে ভারতের সাথে আমাদের আলোচনা করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, হাওর হলো সৌম্য দর্শন পূণ্যভূমি। সকলের অংশগ্রহণে হাওরের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষার পরিকল্পনা করতে হবে। জলাভূমির ইকোসিস্টেম ভ্যালু এবং ধানি জমির ভ্যালুর মধ্যে হাজার গুন পার্থক্য রয়েছে।
জলাভূমিকে ধানের জমিতে পরিণত করা একটি ইনোসেন্ট (নিষ্পাপ) অপরাধ। এটা বন্ধ করতে হবে।
তাসলিমা ইসলাম, প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত), বেলা বলেন যে জলমহাল বন্দোবস্ত নীতিমালায় জলাধারকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে হাওরকে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের পানি আইন, পরিবেশ আইন, প্রাকৃতিক জলাধার সুরক্ষা আইন রয়েছে। হাওরের সুরক্ষায় এই আইনগুলো ব্যবহার করতে পারি। প্রাকৃতিক জলাধার সুরক্ষা আইনে জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না, ভরাট করা যাবে না, তা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। ২০১২ সালের ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ধরেও আমরা হাওর সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারি। হাওরের সুনির্দিষ্ট কোন আইন এখনও পাস হয়নি। খসড়া এই আইনে হাওরের সুরক্ষা বা সংরক্ষণের দায়িত্ব সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয় নি। এই আইনটি দ্রুত পাস করে বাস্তবায়নে যেতে হবে।
ড. লেলিন চৌধুরী (জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নির্বাহী সভাপতি, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) বলেন যে বাংলাদেশে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কোন অ্যাসেসমেন্ট করা হয় না। মানুষের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে হলে আশপাশের অন্যান্য প্রাণীকূলের স্বাস্থ্য ভালো রাখা জরুরী। হাওরে কোন উন্নয়নমূলক কাজ করতে গিয়ে যদি হাওর নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে হাওরের পরিবেশ ও বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর।
পরিবেশবান্ধব হাওর গড়ে তোলার কথা বলেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড এর পরিবেশ ও বন শাখার উপ-প্রধান মোঃ বেলাল উদ্দীন বিশ্বাস। হাওরের ডুবন্ত বাঁধের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন যে এই বাঁধের কারণে হাওরের ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের ভারসাম্য থাকে না। মাছের অভয়ারণ তৈরি হতে পারে না। হাওরের উন্নয়নে একটি অ্যাপেক্স বডি তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।
তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি জীবন হাজং বলেন, একতাই আমাদের মূল শক্তি। ভারত অংশে পাহাড় কাটার কারণে আমাদের অঞ্চলের নদী, জমি বালু দিয়ে ভরাট হয়ে যায়। আমাদের গ্রামের তরুণ-যুবরা মিলে আমরা বাড়ি ঘরের পানি সরাতে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করছি।
সভাপতির বক্তব্যে এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আমাদের প্রথাগত ধারণার জায়গায় আমুল সংস্কার করতে হলে সমন্বয়হীনতা থাকা চলবে না। প্রশাসনকে ভেঙ্গে নতুন করে সাজাতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আমাদের মানসিকতার এবং কাঠামোগত দুটোরই পরিবর্তন প্রয়োজন। হাওর যেহেতু উন্মুক্ত জলাশয় সেহেতু হাওর ইজারা বন্ধ করতে হবে। আমরা হাওরকে কোনভাবেই ধ্বংস হতে দিতে পারি না।
Leave a Reply