বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:২২ অপরাহ্ন

কিভাবে টিমোথি শ্যালামে বব ডিলানের রূপে রূপান্তরিত হলেন

  • Update Time : শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.০২ পিএম

 ব্রায়ান হিয়াট

টিমোথি শ্যালামে আজ উত্তরের দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কানাডা থেকে আশি মাইল দূরে, যেখানে বাতাস সীমান্তে ভারী আঘাত হানে। তার ভাড়া করা টয়োটা পিকআপ ট্রাকটি একটি গাছছায়া আচ্ছাদিত আবাসিক এলাকায় পৌঁছে ইঞ্জিন বন্ধ করেন এবং দেরি জানুয়ারির শীতল বাতাসে নেমে পড়েন। একটি ধূসর সোয়েটশার্টের উপর ডাউন জ্যাকেট এবং তার অগোছালো বাদামি চুল ঢেকে রাখা হুড পরে আছেন। তার গন্তব্য হল একটি বাক্সের মতো ছোট বাড়ি, যার সামনের পথটি দুটি গুল্ম দ্বারা প্রান্তিক। তার পাশে নতুন স্থাপিত সড়ক চিহ্ন: বব ডিলান ড্রাইভ।

এলাকার আইস-ক্যাপড হাইওয়ে ৫৩ ধরে ঘণ্টাখানেকের পথচলা তার জন্য বেশ ক্লান্তিকর ছিল। তবে শ্যালামে তার মিশনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি যুবক বব ডিলানের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতির জন্য চার মাস সময় পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহামারী ও হলিউড ধর্মঘটের কারণে তার হাতে পাঁচ বছর সময় চলে আসে। এই সময়কালে তিনি নিজেকে ডিলানের ভক্ত হিসেবে প্রমাণ করেন, এমনকি ১৯৬৩ সালের বিরল গান ‘পার্সি’স সং’-এর মতো আউটটেকস নিয়ে তার মুগ্ধতা বাড়িয়ে তোলেন।

ডিলানের কণ্ঠস্বর, গিটার বাজানো, এবং চলাচলের ধরন আয়ত্ত করার জন্য তিনি বিভিন্ন কোচের সঙ্গে কাজ করেছেন। এমনকি গান অনুশীলনের সময় তিনি কখনও ডিলানের কণ্ঠস্বরের অনুকরণে কথা বলতেন। শ্যালামে তার গিটারের সুর ও কণ্ঠস্বর সত্যিকারের অভিজ্ঞতায় ধারণ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার যুক্তি, “প্রি-রেকর্ড করা গিটারে গান গাওয়ার সময় কণ্ঠে হাতের আন্দোলনের অভাব বোঝা যায়।”

ডিলান চরিত্রে প্রবেশ করতে গিয়ে শ্যালামে এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছেন যে এখন তিনি গ্রেটফুল ডেডের গানেও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এমনকি ডুন এবং উইলি ওয়াংকার শ্যুটের সেটেও তিনি ডিলানের গান গেয়েছেন।

স্থানীয় হাইস্কুলে একটি সফর শেষে শ্যালামে আবার ফিরে যান সেই বাড়িতে, যেখানে একসময় ডিলান তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ডিলানের পুরোনো রেকর্ড, যেমন লিটল রিচার্ড, জনি ক্যাশ, এবং বাডি হোলির গানের ডিস্ক ঘাঁটাঘাঁটি করেন।

যাওয়ার আগে তিনি বেজমেন্টে ডিলানের তৈরি একটি শিল্পকর্ম দেখেন। ১৯৬০ সালে ওডি গুথরির একটি অ্যালবামের কভারের পেছনে ডিলান তার নিউইয়র্ক অভিমুখী যাত্রাপথের একটি চিত্র অঙ্কন করেন। এটি ছিল তার ভবিষ্যৎ কল্পনা।

“অ্যা কমপ্লিট আননোন” চলচ্চিত্রটি এই সময়কালকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে, যেখানে দেখা যায় কিভাবে ডিলান গুথরির শৈল্পিক উত্তরসূরি হন এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে জনপ্রিয় সঙ্গীতের চেহারা পাল্টে দেন। ডিলানের শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে তার কণ্ঠস্বরের প্রচ্ছন্নতা, এমনকি বৈদ্যুতিক গিটারে তার রূপান্তর – সবই এই সিনেমার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

ডিলানের প্রভাব সঙ্গীতের গণ্ডি পেরিয়ে আরও গভীরে প্রভাব ফেলেছে। তার কাজ প্রমাণ করে যে গানের কথা কবিতার মতো হতে পারে এবং একজন শিল্পী তাদের জীবন ও যুগের সঙ্গতি বদলাতে পারে।

শ্যালামে ডিলানের চরিত্রে অভিনয় করে শুধু এই কিংবদন্তি শিল্পীকে সম্মান জানাননি, বরং তার নিজস্ব শৈল্পিক ক্ষমতারও একটি অভূতপূর্ব উদাহরণ স্থাপন করেছেন। শ্যালামে এই চরিত্রের প্রস্তুতিতে যেমন নিজেকে ডিলানের দুনিয়ায় গভীরভাবে ডুবিয়েছিলেন, তেমনই পরিচালক জেমস ম্যানগোল্ডও নিশ্চিত করেছেন যে, এই চলচ্চিত্রটি কেবল ডিলানের গল্প বলার জন্য নয়, বরং সঙ্গীত ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তুলে ধরার জন্য। “অ্যা কমপ্লিট আননোন” সিনেমার মাধ্যমে তারা ডিলানের চার বছরের সৃজনশীল অভিযাত্রা তুলে ধরেছেন – সেই সময় যখন তিনি লোকসংগীতের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বৈদ্যুতিক সঙ্গীতে নিজের নতুন পরিচয় তৈরি করেছিলেন।

চলচ্চিত্রে ডিলানের শিল্পী জীবনের বিভিন্ন মাইলফলক চিত্রায়িত হয়েছে। তার সঙ্গীতগুরু ওডি গুথরির সঙ্গে প্রথম দেখা এবং গিটারে গুথরির গান শোনানোর মুহূর্তটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি, পিট সিগারের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার প্রথম প্রেম সুজ রোটোলোর (চলচ্চিত্রে সিলভি রুসো নামে পরিচিত) সঙ্গে জটিল রসায়নকেও দেখানো হয়েছে। এছাড়া, জোয়ান বায়েজের সঙ্গে তার সঙ্গীত ও রোমান্টিক সম্পর্ককেও চলচ্চিত্রে চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।

ডিলানের প্রভাব শুধু সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার গান সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। “ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড” কিংবা “দ্য টাইমস দেয় আর আ-চেঞ্জিং” এর মতো গানগুলো প্রজন্মের এক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

চলচ্চিত্রের নির্মাতা এবং অভিনেতারা স্বীকার করেছেন যে, ডিলানের মতো একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরা সহজ ছিল না। তবে, টিমোথি শ্যালামে তার অভিনয়ের মাধ্যমে ডিলানের ভক্তদের কাছে সত্যিকার অর্থে তার সত্ত্বাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তার কণ্ঠস্বর, অভিব্যক্তি এবং চলন-বলনে ডিলানের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়েছে।

চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ডিলানের যাত্রা নতুন প্রজন্মের কাছে আবারও উন্মোচিত হয়েছে। এটি শুধু বব ডিলানের গল্প নয়, বরং সঙ্গীত এবং সামাজিক পরিবর্তনের একটি অসামান্য অধ্যায়। শ্যালামের চেষ্টার মাধ্যমে, ডিলানের উত্তরাধিকার আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। “অ্যা কমপ্লিট আননোন” একটি প্রমাণ যে, ডিলানের প্রভাব এবং সৃষ্টিশীলতা কখনো পুরনো হয় না।

চলচ্চিত্রটি ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এটি শুধু ডিলানের ভক্তদের জন্যই নয়, বরং সঙ্গীত ইতিহাস এবং সৃজনশীলতার প্রতি আগ্রহী সকল দর্শকের জন্য একটি অপরিহার্য অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। চলচ্চিত্রে ডিলানের সঙ্গীত যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে, তার লোকসংগীত থেকে বৈদ্যুতিক সঙ্গীতে রূপান্তরের সময়কালটি গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই রূপান্তর শুধু তার সঙ্গীত জীবনে নয়, সঙ্গীত ইতিহাসেও একটি যুগান্তকারী ঘটনা হয়ে আছে। ডিলানের এই পদক্ষেপ ভক্তদের মধ্যে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, তেমনই এটি প্রমাণ করে যে, তিনি একজন উদ্ভাবনী এবং নির্ভীক শিল্পী।

চলচ্চিত্রের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, এতে ডিলানের গানগুলো চমৎকারভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টিমোথি শ্যালামে নিজেই কিছু গান লাইভ পরিবেশন করেছেন, যা সিনেমাটিকে আরও বাস্তবসম্মত করেছে। শ্যালামে বিশ্বাস করেন যে, “লাইভ পরিবেশনা কেবল শারীরিক অভিব্যক্তি এবং কণ্ঠস্বরের মধ্যকার সংযোগ প্রকাশ করে।”

পরিচালক জেমস ম্যানগোল্ড এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণে তার সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন। এটি শুধুমাত্র ডিলানের জীবনকে চিত্রিত করা নয়, বরং সেই সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও তুলে ধরে। ম্যানগোল্ড এই জটিল চরিত্র এবং সময়কে জীবন্ত করতে একাধিক উপাদান ব্যবহার করেছেন, যা সিনেমার গভীরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ডিলানের চরিত্রে টিমোথি শ্যালামের নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত। শ্যালামের অসাধারণ অভিনয় এবং ডিলানের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি শুধু ডিলানের সঙ্গীত এবং তার সময়কালের আবহকে ধরতে সক্ষম হননি, বরং তার ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত জটিলতাকেও তুলে ধরেছেন।

এছাড়া, চলচ্চিত্রে সমসাময়িক চরিত্রগুলোর উপস্থিতি – যেমন পিট সিগার এবং জোয়ান বায়েজ – ডিলানের জীবনের গল্পকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই চরিত্রগুলো তাদের নিজ নিজ অভিনয়ের মাধ্যমে ডিলানের যাত্রায় একটি বাস্তব এবং মর্মস্পর্শী প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।

অবশেষে, “অ্যা কমপ্লিট আননোন” শুধুমাত্র বব ডিলানের একটি জীবনীমূলক চলচ্চিত্র নয়, এটি একজন শিল্পীর সৃজনশীলতাকে শ্রদ্ধা জানানোর এক অনন্য প্রয়াস। ডিলানের মতো একজন আইকনিক শিল্পীর জীবন, তার সঙ্গীত, এবং তার সময়ের প্রভাবকে ধারণ করা সহজ নয়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি দেখায় যে, তার গল্প আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রেরণাদায়ক।

“অ্যা কমপ্লিট আননোন” শুধু ডিলানের ভক্তদের জন্য নয়, বরং সঙ্গীত এবং সৃজনশীলতার প্রতি গভীর আগ্রহী সকলের জন্য একটি আবশ্যিক দেখা সিনেমা। ডিলানের উত্তরাধিকার নতুন প্রজন্মের কাছে পুনরুজ্জীবিত করার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে সঙ্গীত ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024