মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:৫৫ অপরাহ্ন

কাগুজে বাঘ

  • Update Time : শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ পিএম

আবু ইসহাক

বিড়ালকে বলা হয় বাসের মাসি। বাঘ কিন্তু মাসিদের খাতির করে না। খিদে পেলে থাবা দিয়ে মাসিদেরও ধরে খেয়ে ফেলে। তাই বোনপোকে ভীষণ ভয় করে মাসিরা। একবার এক মাসি তার বোনপোকে দেখে নয়, এক বোনপোর কাগুজে ছবি দেখে ভড়কে গিয়ে লুটোপুটি খেয়ে কাতরাতে কাতরাতে পালিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল করাচীতে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীনতার পর করাচী শহরের জাহাঙ্গীর রোড পূর্ব এলাকায় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জরুরি প্রয়োজনে পাকা ছাদওয়ালা অনেক ব্যারাক বানানো হয়েছিল। প্রত্যেকটি ব্যারাককে ছ’টি ভাগ করে তৈরি করা হয়েছিল ছ’টি বাসা। এই বাসার একটিতে থাকতেন ইলিয়াস।

দুই কক্ষের ছোট্ট বাসা। পিছনে খোলা বারান্দা ও উঠোন। সামনের খোলা বারান্দার বাইরে গুল্মের বেড়া দিয়ে ঘেরা একচিলতে বাগান। এই বাগানে কেউ-কেউ দু’ চারটে ফুলের গাছ লাগাতেন। তবে বাঙালিদের অধিকাংশই সেখানে শাক-সবজির চাষ করতেন। শাক-সবজির বীজ তাঁরা নিয়ে যেতেন দেশের বাড়ি থেকে। ইলিয়াসও দেশের বাড়ি থেকে বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ এবং সাত-আট জাতের শিমের বীজ নিয়ে গিয়েছিলেন।

শিমের বীজ লাগাবার এক নতুন পদ্ধতির কথা শুনেছিলেন ইলিয়াস। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি দুই ফুট দীর্ঘ, দুই ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট গভীর একটা গর্ত করেন বাগানে। গর্তের মাটির সাথে তিন পোয়া সর্ষের খৈল, একপোয়া হাড়ের গুঁড়ো, তিন ছটাক পুসার ফসফেট, দুই ছটাক পটাশ এবং একঝুড়ি জৈব সার মিশিয়ে রেখে দেন প্রায় একমাস। তারপর কাতলাকানি, খলসেকানি, ঘৃতকমলি, চামুয়া, জামাইপুলি, নলডোগ ও লালশিরা-এই সাত প্রজাতির দুটো করে চৌদ্দটা শিমের বীজ ঐ গর্তের মধ্যে রেখে ওগুলোকে ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দেন। এবার হাতের দাবনা দিয়ে আস্তে আস্তে থাবড়া মেরে মেরে মাটি সমান করে সামান্য পানি ছিটিয়ে দেন তার ওপর।

চার-পাঁচ দিন পর বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চৌদ্দটা চারাগাছ মাটির ওপর উঠে আসে। গাছগুলোকে তাঁর বাসার ছাদে উঠবার জন্য ইলিয়াস মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত একটা দড়ি টাঙিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যে সতেজ শিমলতাগুলো পরস্পরকে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে গলাগলি-কোলাকুলি করে দড়িটা বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। ছাদের গরমে গাছগুলো যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সে-জন্য ইলিয়াস ছাদের ওপর বেশ কয়েকটা পেয়ারার ডাল বিছিয়ে দেন। ছাদে উঠে শিমলতাগুলো আলাদা হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডালগুলো ছেয়ে ফেলে।

কিছুদিন পরেই পেখম-ধরা শিমলতায় মুকুল ধরতে শুরু করে। কিন্তু বৃষ্টিবিরল মরুময় অঞ্চলের ক্ষুধার্ত চড়ুইয়ের নজরে পড়ে সেই মুকুল। ফুল ফোটার আগেই ওরা ঝাঁক বেঁধে খেয়ে নেয় সেই মুকুল। যতটা খায়, শক্ত ঠোঁট দিয়ে কেটে তছনছ করে তার অনেক বেশি। ইলিয়াস চিন্তায় পড়ে যান। ভাবতে থাকেন, চড়ুইয়ের এ হামলা কী করে ঠেকানো যায়। প্রথমেই তাঁর মনে পড়ে বিড়ালের কথা। বিড়ালকে ভীষণ ভয় পায় চড়ুই। কিন্তু আদেশ জারি করে বিড়ালকে তো আর শিমগাছ পাহারার ডিউটি দেয়া যায় না। নিজের পোষা বিড়াল থাকলে না হয় সেটার গলায় বা পায়ে রশি লাগিয়ে ছাদের ওপর বেঁধে রাখা যেত।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় ইলিয়াসের মাথায়। গতবছরের একটা বড় ক্যালেন্ডার রয়েছে তাকের ওপর। ছেলে-মেয়েদের বইয়ের মলাট দেয়ার জন্য সেটা রাখা হয়েছে। ঐ ক্যালেন্ডারে বিড়ালের নয়, বিড়ালগোত্রীর সবচেয়ে বড় বিড়ালের অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজবংশী বাঘের ছবি আছে।

ইলিয়াস ক্যালেন্ডারটা বের করে বাঘের ছবির বাইরের রেখা ধরে ধরে কেটে নিলেন কাচি দিয়ে। বাঘের ছবিটা এবার একখণ্ড পিজবোর্ডের ওপর আঠা দিয়ে সেঁটে পিজবোর্ডটাকে বাঘের ছবির সাথে মিলিয়ে কেটে নিলেন। বেশ চমৎকার কাগুজে বাঘ তৈরি হয়েছে। ওটার আকার বিড়ালের চেয়ে একটু বড়ই হবে। পাছার ওপর ভর দিয়ে পেছনের দুটো পা গুটিয়ে মাথা উঁচিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসেছে, ডোরাকাটা বাঘটা। সামনের পা দুটো মাটির ওপর লম্বামান। ভীষণদর্শন বাঘের দুটো চোখে হিংস্রতা জ্বলজ্বল করছে।

ছাদের ওপর বিছানো পেয়ারার ডালের দুটো শাখার মাঝে বাঘের ছবিটাকে রেখে ইলিয়াস ওটাকে সুতো দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেন। এখন থেকে চড়ুইয়ের ঝাঁক আর শিমগাছের ধারে কাছে আসতে সাহস করবে না-ভাবেন ইলিয়াস।

কিন্তু কাজ হলো না। নড়ে না চড়ে না, শব্দ করে না-এমন জড় পদার্থ দেখে চড়ুইরা বুঝতেই পারে না ওটা তাদের শত্রু। তাই ওদের হামলা চলতেই থাকে। দিনে- রাতে যে মুকুলগুলো বের হয়, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার আগেই চড়ুই পাখির ঝাঁক সেগুলোকে খেয়ে আর কেটেকুটে সাবাড় করে দিয়ে যায়। এই হামলা রোধ করতে না পারলে শিম খাওয়ার আশা ছেড়েই দিতে হবে ইলিয়াসকে।

অনেক ভেবেচিন্তে ইলিয়াস নতুন একটা উপায় বের করেন। তিনি সাদা, কালো ও কমলা রঙের সরু সুতোর কাটিম থেকে একহাত করে লম্বা গোটা চল্লিশেক খণ্ড ছিঁড়ে নেন। ছাদে বিছানো পেয়ারার ডালের উঁচু হয়ে থাকা বিভিন্ন শাখার আগায় বেঁধে দেন সুতোর এই খণ্ডগুলোর একপ্রান্ত। সুতোগুলো বাতাসে এমনভাবে নড়ে, যেন সুতোনেলে সাপ গাছের শাখায় লেজ পেঁচিয়ে মাথা বাড়িয়ে ছোবল মারার চেষ্টা করছে।

এবার কাজ হয়েছে। চড়ুইয়ের ঝাঁক ছাদের ওপর উড়ে আসে ঠিকই, কিন্তু সাপের মতো ছোবল মারতে উদ্যত সুতোগুলো দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়।

কয়েক দিনের মধ্যে মুকুল ও ফুলে ভরে যায় শিমগাছ। মধুর জন্য অসংখ্য মৌমাছি এসে পরাগসংযোগ ঘটিয়ে যায়। আরও দিন কয়েক পরে দেখা যায় থোকায় থোকায় শিম ঝুলছে। সাত রকমের শিম-নানা আকারের, নানা রঙের। দেখে ইলিয়াসের চোখ জুড়িয়ে যায়। একদিন বিকেলবেলা। উঠানে দাঁড়িয়ে ইলিয়াস মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ফুলে-ফলে ভরা শিমলতার দিকে। কাগুজে বাঘটা তখনও ছাদ থেকে নামানো হয়নি।

ইলিয়াস দেখতে পান, পশ্চিম দিক থেকে ছাদের ওপর দিয়ে পুবদিকে আসছে একটা বিড়াল। বাঘের ছবির দিকে তাকিয়েই ওটা আঁতকে উঠে কেমন এক ‘ওঁহুপ’ শব্দ করে ছাদের ওপর চিৎপাত হয়ে যায়। কয়েকবার লুটোপুটি খেয়ে আঁআঁ-আঁআঁ-আঁআঁ আর্তচীৎকার করে লেজটাকে গুটিয়ে পেটের তলায় নিয়ে গড়াতে গড়াতে, ছেঁচড়াতে- ছেঁচড়াতে কিছু দূর গিয়ে কোনোরকমে উঠে ভোঁ এক দৌড় মেরে ছাদের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে লাফ দিয়ে নিচে নেমে যায়।

এ ঘটনার তেরো বছর পর ইলিয়াস পাকিস্তান থেকে পালিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। চাকরি থেকে অবসরগ্রহণেরও কয়েক বছর পর তিনি ঢাকায় এসে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন।

ছোট-বড় নানা উপদ্রবের মধ্যে দিন কাটে ঢাকায়। এখানে আসার সাথে সাথেই যেটা শুরু হয় সেটা বিড়ালের উপদ্রব। সুযোগ পেলেই বিড়াল রান্নাঘরের জানালা দিয়ে এসে হাঁড়ি থেকে মাছ-মাংসের টুকরো নিয়ে পালিয়ে যায়। দুধের হাঁড়িতে মুখ দিয়ে দুধ খেয়ে যায়। বিড়ালের মুখ দেয়া খাবার ফেলে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

সাতাশ বছর পর বিড়াল ও কাগুজে বাঘের ঘটনাটা ইলিয়াসের মনে পড়ে যায়। বাঘের ছবি আছে এমন একটা ক্যালেন্ডার তিনি সংগ্রহ করেন। করাচীতে যেমন করেছিলেন তেমনি করে তৈরি করেন একটা কাগুজে বাঘ। নখর-বের-করা থাবা উঁচিয়ে শিকার ধরার জন্য লক্ষমান এ বাঘ। করাচীর বাঘটার চেয়ে এটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

বেশ উৎসাহের সাথে তিনি কাগুজে বাঘটাকে রান্নাঘরের জানালায় বসিয়ে দেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! বিড়াল আগের মতোই এসে মাছ-মাংসের টুকরো নিয়ে যায়, দুধ খেয়ে যায়। কাগুজে বোনপোকে দেখে মাসি মোটেই ভয় পায় না। ইলিয়াস হতভম্ব। তিনি এর কারণ কী বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তাঁর মনে হয়, পাকিস্তানের কোথাও বাঘ নেই। সেখানে খাটাশের চেয়ে বড় বিড়াল-গোত্রীয় কোনো প্রাণীও নেই। তাই পাকিস্তানের বিড়ালকে বলা যায় খাটাশের মাসি। তাই বোধহয় খাটাশের মাসি কাগুজে বাঘ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে ভিরমি খেয় চিৎপাত হয়ে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশ বাঘের দেশ। এখানকার বিড়াল বাঘের মাসি। বাংলাদেশের বিড়াল তাই কাগুজে বাঘ দেখে ভয় পায় না।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024