ম্যাকসিম গোর্কী
বত্রিশ
ভরা অঞ্চলের কোনো পাদরির মতো তিনি মাঝে মাঝে যেমন আত্মম্ভরী, তেমনি অসহিষ্ণু হ’য়ে উঠেন। যে মানুষযাট এই পৃথিবীতে শুভ ঘণ্টাধ্বনির মতো বিরাজ করছেন, তাঁর মধ্যে এই ব্যাপারটি কিন্তু ভয়ানক। গত কাল তিনি আমাকে বলেছিলেন:
“তোমার চেয়ে আমার মধ্যে কৃষকের দিকটা আছে অনেক বেশি। তাই চাষাড়ে ভংগীতে চিন্তা করতে আমার বেশ লাগে।”
ও হরি, এ নিয়ে বড়াই করা উচিত ছিল না, অবশ্যই না!
তেত্রিশ
আমি তাঁকে আমার ‘রসাতল’ নাটকের কয়েকটি দৃশ্য প’ড়ে’ শোনাছিলাম; তিনি মনোযোগ সহকারে শুনলেন, অতঃপর বললেন: “তুমি ওটা লিখলে কেন?”
আমি যথাসাধ্য ব্যাখ্যা করলাম। “সর্বদাই দেখি, তুমি মুরগীর মতো সব জিনিষের ওপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছ। কেবল তাই নয়-সমস্ত খোপের সমস্ত ফাটল তুমি সর্বদা তোমার নিজের রঙ দিয়ে রাঙিয়ে রাখতে চাও। তোমার মনে আছে, এণ্ডারসেন বলেছিলেন: ‘সোনালি রঙ খসে যাবে, থাকবে কেবল শুয়োরের চামড়াটা। আমাদের চাষারাও ঠিক ওই কথাই বলে: ‘সব যাবে চলে, থাকবে কেবল যা সত্যি।’ সুতরাং, চুনকাম না করাই তোমার পক্ষে শ্রেয়। নইলে পরে তোমায় পস্তাতে হবে। তাছাড়া, অত্যন্ত নৈপুণ্য তোমার ভাষায়-তাতে আছে সকল রকমের প্যাঁচ। ওটা ভালো নয়। আরো সহজ ক’রে তোমার লেখা উচিত; সহজভাবেই মানুষ কথা বলে; এমন কি তাদের কথার মধ্যে সংগতিও থাকে না; এবং তাই ভালো। কোনো চাষা কখনো প্রশ্ন করে না: চার যদি তিনের চেয়ে বেশি হয়, তবে একের চার একের
তিনের চেয়ে বেশি নয় কেন?’ একজন শিক্ষিতা তরুণী ভদ্রমহিলা এই প্রশ্ন করেছিলেন। দয়া ক’রে ওসব প্যাঁচগুলো ছাড়ো।”
তিনি বিরক্তির সংগে কথাগুলি বললেন; স্পষ্টত আমি তাঁকে যা পড়ে শুনিয়েছিলাম, তা তাঁর অত্যন্ত অপছন্দ হয়েছে। একটুক্ষণ নীরব থেকে আমার মাথার ওপরে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর ক’রে বলতে লাগলেন:
“তোমার ওই বুড়োর মধ্যে সহানুভূতি নেই; তার সততায় মানুষ বিশ্বাস করে না। অভিনেতাটি ঠিক হয়েছে, সে ভালই। আমার লেখা ‘জ্ঞানের ফসল’ পড়েছ? সেখানে আমার পাচক যেমন, তোমার অভিনেতাটি ও কতকটা তেমনি। নাটক লেখা বড়ো কঠিন। কিন্তু তোমার বেশ্যাটি ও হয়েছে বেশ, ওদের অমনটিই হওয়া উচিত। তুমি ওদের অনেককে চেনো, তাই না?”
“এক সময় চিনতাম।”
“হ্যাঁ, সেটা স্পষ্টই চোখে পড়ে। সত্য সর্বদাই নিজেকে প্রকাশ করে। তুমি যা বলেছ, তার অধিকাংশটুকুই তোমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাই তোমার রচনার মধ্যে চরিত্র দেখা যায় না; সব মানুষগুলোরই যেন এক রকম মুখ। আমার মনে হয়, মেয়েদের তুমি বোঝো না; তোমার হাতে ওরা ভালো আসে না। ওদের কথা কারো মনে থাকে না।…….”
ঠিক সেই মুহূর্তে এ, এস,-এর স্ত্রী ঘরে এলেন এবং চা খেতে যাবার জন্যে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। নিকোলাইয়েভিচ অত্যন্ত দ্রুত উঠে ঘরের বাইরে গেলেন, যেন তিনি আলাপটা কোনো রকমে শেষ করতে পেয়ে খুশীই হয়েছেন।
Leave a Reply