বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথম দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
একই সঙ্গে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তার নেতৃত্বে আগামী মাসেই কাজ শুরু করবে বলে তিনি জানিয়েছেন। ওই কমিশনের কাজই হবে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব বিষয় জরুরি, সেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়ে গেছে। কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখন থেকে তাদের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হলো ভবিষ্যৎ সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করার। তারা তাদের প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছেন। “
বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার সকালে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে এই ভাষণ দেন।
মি. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা উল্লেখ করলেন। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনের একটি সময়সীমা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিলো।
রোববার দলের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের আর কত মাস প্রয়োজন, তা জানার অধিকার জনগণের আছে।
ওই অনুষ্ঠানেই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অতি দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংস্কারের পথকে সুগম করতে হবে। এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন’।
অবশ্য সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গত সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনের জন্য ১৮ মাসের একটি সময়ের উল্লেখ করেছিলেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
যদিও সরকার শুরুতে সংস্কার কর্মসূচির দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছিলো। তবে সরকারের দু,একজন উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এলেও পরে তারা বলেছেন, এটি প্রধান উপদেষ্টার এখতিয়ার এবং তিনিই সেটি ঘোষণা করবেন।
প্রধান উপদেষ্টা সোমবার তার ভাষণে বলেছেন, তিনি প্রধান সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে বারবার আবেদন জানিয়ে আসছেন।
“তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে,” বলেছেন তিনি।
অর্থাৎ তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটি উঠে এসেছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি আগামী বছরের শেষ থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে যে কোন সময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সোমবার ভোরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন হচ্ছে
গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আটই অগাস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছিলেন। এর বাইরে অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য একটি শ্বেতপত্র কমিটি করা হয়েছিলো, যারা ইতোমধ্যেই তাদের রিপোর্ট দিয়েছে।
সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ছয়টি সংস্কার কমিশন শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে।
“আমরা এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা,” তিনি বলেছেন।
মি. ইউনূস জানান, তিনি নিজেই এই কমিশনের প্রধান থাকবেন। আর এর সহ-সভাপতি থাকবেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশন মনে করলে নতুন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।
এখন যে ছয়টি কমিশন কাজ করছে তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আগামী মাসেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
“এই নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে সমস্ত সিদ্ধান্ত জরুরি, সে সমস্ত বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা”।
গত আটই অগাস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
‘দাম কমানোর চেষ্টা করছি’
বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরেই আলোচনায় আছে দ্রব্যমূল্য। সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। প্রধান উপদেষ্টার আজকের ভাষণে এ বিষয়টিও উঠে এসেছে।
মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে স্বীকার করে নেন যে আন্তরিকভাবে কাজ করলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য তারা এখনো পাননি এবং বাজারে গত কয়েক মাসে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।
“তবে আমার বিশ্বাস মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে এবং বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এটা হলে জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে,” বলেছেন তিনি।
আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেছেন যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে তাকে কঠোর হাতে দমন করবেন তারা।
‘স্বৈরাচার ও দোসরদের বিচার’
প্রধান উপদেষ্টার তার এই ভাষণে জানান যে ‘পতিত স্বৈরশাসক ও তার দোসরদের’ বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সব ধরনের সুযোগ তারা পাবেন।
“বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আসামিদের বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব ধরনের সুযোগ তারা পাবেন। বিচার প্রক্রিয়া সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিচারের যেকোনো অংশ চাইলে যে কেউ রেকর্ড করার সুযোগ পাবেন”।
তিনি জানান ‘গণহত্যাকারীদের’ বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করবেন বলে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খানকে তিনি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন
‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা এসেছে’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে দাবি করেছেন যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ও নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে এবং কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি।
“ব্যাংক যতই দুর্বলই হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমদিকে আমানতকারীর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এখন সেটা তুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংককে আমানতকারীর আমানত ফেরত দেবার জন্য নতুন টাকার সরবরাহ দিতে প্রস্তুত হয়েছে। আশা করি এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সকলের আস্থা ফিরে আসবে।”
ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে।
“পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই টাকা। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগ বিলাসে ব্যয় করেছে,” বলেছেন তিনি।
“এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন, কারণ এ বিষয়ক আইন কঠিন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে সাহস ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বারবার বলছি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আংশিক টাকা হলেও যেন ফেরত আনা যায়”।
‘গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের দলিল’
বর্তমান সরকার গঠিত গুম কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন এটা একটা ‘লোমহর্ষক প্রতিবেদন’। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে এতে আছে তার বিবরণ।
“অবিশ্বাস্য বর্ণনা। সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাদের ভয়, হঠাৎ যদি ঐ জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে,” ভাষণে বলেছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, শনিবার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুম সম্পর্কিত তদন্ত কমিশন। সেই প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply