শশাঙ্ক মণ্ডল
সাহিত্য
পঞ্চম অধ্যায়
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে তৎকালীন সুন্দরবনের বিভিন্নপ্রান্তে যে সব গ্রামের অস্তিত্ব ছিল বা প্রজাবিলির মধ্য দিয়ে যে সব নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছিল সেগুলিতে দেবোত্তর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন সংস্কৃত, আরবি ফারসি ভাষায় শিক্ষিত পণ্ডিতরা এবং ধর্মাচনার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। সে যুগে বনভূমি বাদ দিলে সুন্দরবনের উত্তরাংশের সমস্ত ভূ-সম্পত্তি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তীকালে ইংরেজ রাজত্বে কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর জমিদারির সীমা ছোট হয়ে যায় এবং সৈদপুর সাতক্ষীরা টাকী, নদীয়ার পালচৌধুরী, হাড়োয়ার মুন্সিআমির, নাড়াইলের রাজা, বারুইপুর প্রভৃতি অসংখ্য ছোট জমিদারির পত্তন ঘটে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দেবোত্তর সম্পত্তি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, আরবি ফারসি ভাষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের, চারু, কারু, শিল্পীদের, মন্দির, মসজিদ পীরের নামে দান করেছিলেন। এসব ব্যক্তিরা হিন্দু মুসলমানের দৈনন্দিন পুজা-অর্চনা শাস্ত্রপাঠ শরিয়তের ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠানের পাশাপাশি টোল চতুষ্পাঠী তোলবাখানা, মক্তব মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিলেন।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তাঁর কাছ থেকে যে ব্রাহ্মণ পুরস্কৃত হয়নি তিনি ব্রাহ্মণই নন। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ উপলক্ষে তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের প্রচুর উপঢৌকন দেন এবং এক বিশাল পণ্ডিতসভার অয়োজন করেন। সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাসিক ১০০ টাকা বরাদ্দ করেন নদীয়ার টোলের দূরদেশাগত ছাত্রদের জন্য। তৎকালীন সুন্দরবন এলাকার বিভিন্ন মন্দির, মসজিদ, পীরের দরগাকে উৎসর্গীকৃত দেবোত্তর ভূমি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থিত।
সেদিন ফারসি ছিল সরকারি ভাষা এবং তা ব্রিটিশ রাজত্বে ১৮২৫-৩০ পর্যন্ত বেশ কিছুটা চালু ছিল। ফারসি শেখার জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মহারাজের আশ্রয়ে নদীয়া শান্তিপুর কৃষ্ণনগর, কুষ্টিয়ার মেহেরপুর, যশোর খুলনা বাগেরহাট ২৪. পরগনার, বারুইপুর বারাসত কাজিপাড়া, দমদম বসিরহাট হাড়োয়া হাকিমপুর প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে ছিল। সেদিন প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব ছিল পাঠশালার ওপর; শিক্ষিত মানুষদের একটা বড় অংশ পাঠশালার শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে তাদের ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটতো।
প্রাথমিক শিক্ষায় লেখাপড়া ও কিছুটা অঙ্কের প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হত। মাস্টারমশাই অন্যান্য কাজের পাশাপাশি পাঠশালা চালাতেন। মুদিখানা দোকান ও সেই সঙ্গে পাঠশালা। অনেক সময় দূরের কোন শিক্ষিত লোক পাঠশালার দায়িত্ব নিতেন। গ্রামের অবস্থাপন্ন লোকদের চণ্ডীমণ্ডপ, বারোয়ারি কোন জায়গা, মন্দির মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে এই পাঠশালার কাজ চলত। শিক্ষার্থীদের বাৎসরিক ধানের চুক্তিতে পণ্ডিতমশাই এর ভরণপোষণের কাজ চলত। এর থেকে ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা প্রবাদটির জন্ম।
Leave a Reply