সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:০৩ অপরাহ্ন

রঙ-রঙ্গ

  • Update Time : শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৬.৪৩ পিএম

আবু ইসহাক

মানুষের মুখের চেহারা দেখে নাকি তার মনের চেহারার পরিচয় পাওয়া যায়। পোশাক পরিচ্ছদ দেখে নাকি তার স্বাভাব-চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু ইলিয়াস চেহারা- সুরত দেখে, পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মানুষ চিনতে ভুল করেছেন অনেক বার। অতএব, অনেক বারই তাঁকে ঠক খেয়ে ঠগ্‌গীশ হয়ে মাথায় হাত দিতে হয়েছে।

১৯৭৬ সালের কথা। মাত্র কয়েক মাস আগে ইলিয়াস বিদেশস্থিত এক বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে বদলি হয়ে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিয়েছেন। সন্ধ্যার কিছু পরে রেডিওর ঘোষণা শোনা গেল, চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল ঈদ। ইলিয়াস খবর নিয়ে জানলেন, সহকর্মীদের সবাই ঈদের নামাজ পড়তে গড়ের মাঠে যাবেন। সবচেয়ে বড় জামাত পড়তে হলে একটা জায়নামাজের দরকার।

জায়নামাজ কেনার জন্য ইলিয়াস তখনই ছুটলেন মল্লিকবাজারে। বড় একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে তিনি বসলেন। দোকানের মালিকের কাঁচা-পাকা চাপদাড়ি- শোভিত মুখ, পরিধানে কলিদার পাঞ্জাবি, মাথায় গোল টুপি দেখে তাঁকে একজন আল্লাহওয়ালা সৎ মুসলমান বলেই তাঁর মনে হলো। জায়নামাজ চাইতেই তাঁর কর্মচারী বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন দামের কয়েকটা জায়নামাজ দেখাল। তার থেকে বেছে মসজিদ ও চাঁদ-তারা অঙ্কিত সুন্দর একটা জায়নামাজ পছন্দ করলেন ইলিয়াস। দাম জিজ্ঞেস করতেই মালিক পঁয়ত্রিশ টাকা দাম চাইলেন। ইলিয়াস বললেন, দেখতে তো খুব সুন্দর। রং উঠবে না তো?

-না-না, পাকা রঙ। আমাদের নিজেদের কারিগর দিয়ে তৈরি। সোডা দিয়ে সেদ্ধ করলেও রং উঠবে না।

রং-সম্বন্ধে দোকানদার আশ্বাস দেওয়ায় আর দরাদরি না করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তাঁর হাতে দিলেন ইলিয়াস। তিনি অন্যান্য খদ্দেরদের সাথে কথা বলতে বলতে বাঁ হাত দিয়ে নোটটা ক্যাশবাক্সের মধ্যে রাখলেন এবং কথা বলতে বলতেই ডান হাত দিয়ে ক্যাশবাক্স থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার, একটা দশ টাকার এবং একটা পাঁচ টাকার নোট-মোট পঁয়ষট্টি টাকা গুণে ইলিয়াসের হাতে দিলেন।

-এত দিচ্ছেন কেন? অবাক হয়ে বললেন ইলিয়াস।-আমি তো পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছিলাম।

-ওহহো, তা-ই নাকি! আমি মনে করেছিলাম আপনি একশ টাকার নোট দিয়েছিলেন।

দোকানের মালিক পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলেন কোনোরূপ ধন্যবাদ না জানিয়েই। ইলিয়াস জায়নামাজ নিয়ে বাসায় এলেন।

পরের দিন জায়নামাজ বগলে নিয়ে সহকর্মীদের সাথে ইলিয়াস গড়ের মাঠে গেলেন ঈদের নামাজ পড়তে। আগের দিন একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। মাঠের ঘাস তাই ভেজা- ভেজা। তার উপর জায়নামাজ বিছিয়ে তিনি বসে গেলেন। নামাজের সময় তখনো হয় নি। ইমাম সাহেবের ওয়াজ-নসিহত চলছিল তখন। তা-ই বসে বসে শুনতে লাগলেন তিনি।

যথাসময়ে নামাজ শেষ হলো। পাশে রাখা জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে জায়নামাজটা ভাঁজ করে দাঁড়াতেই সহকর্মীরা এলেন কোলাকুলি করতে। ইলিয়াসও এক সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে ‘ঈদ মোবারক’ বলে দু’হাত তাঁর দিকে বাড়াতেই তিনি হঠাৎ পিছিয়ে গেলেন। বললেন,-এ কী ভাই, ঈদের দিন হোলি খেলে এলেন কোত্থেকে?

এতক্ষণে ইলিয়াসের চোখ পড়ে পাঞ্জাবির হাতার দিকে। লাল-নীল-সবুজ-হলুদের খিচুড়ে রঙে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে পাঞ্জাবির হাতাদুটো। পাশে দাঁড়ানো আরেক সহকর্মী বললেন,-রঙের ছাপ পেছন দিকটায় পড়েছে আরো বেশি।

ইলিয়াস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, পাজামা-পাঞ্জাবির পিছনের নিচের দিকের অবস্থা আরো শোচনীয়।

নিজেদের কাপড়ে রং লাগার ভয়ে সহকর্মীদের কেউ আর ইলিয়াসের সাথে কোলাকুলি করলেন না। অনেকের মতো তাঁরাও জানেন, এক কাপড়ের কাঁচা রঙ আরেক কাপড়ে পাকা হয়ে বসে যায়। সে-রঙের চাপ আর কোনো দিন ওঠে না।

রঙে রাঙানো পোশাক নিয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে ইলিয়াস তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়ে বসলেন। বাসায় ফেরার পথে তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন-টুপি-পরিহিত চাপদাড়ি-শোভিত দোকানদারের নিজের কারিগর দিয়ে তৈরি জায়নামাজের পাকা রঙ যা সোডা দিয়ে সেদ্ধ করতেও ওঠে না, তা ঘাসের পানিতে গলে কেমন করে রাঙিয়ে দিলে তাঁর পাঞ্জাবি আর পাজামাটা। এ দুটো আর কোনো দিন ব্যবহার করা চলবে না।

ইলিয়াসের তখন আরো একটা কথা মনে হয়েছিল: দোকানাদারের বিবেক জানত ক্রেতার পাজামা-পাঞ্জাবি বরবাদ হবে। ক্রেতার সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে দেওয়ার জন্যেই বোধহয় বিবেকের প্রচ্ছন্ন নির্দেশে দোকানদারের বিদ্রোহী হাত জায়নামাজের সাথে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়েছিল। কিন্তু ক্রেতা নিজের বিবেকের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে সে টাকা পকেটস্থ করতে পারেন নি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024