শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর টোটব্যাগের রাজনীতিতে মিশলো বাংলাদেশের হিন্দু ইস্যু

  • Update Time : বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১.৪৪ পিএম
মঙ্গলবার পার্লামেন্টের সামনে বাংলাদেশ ইস্যুতে কংগ্রেস এমপিদের বিক্ষোভ

শুভজ্যোতি ঘোষ

কাঁধ থেকে ঝোলানো হয়, এরকম সামান্য এক কাপড়ের টোটব্যাগ – যার কোনওটায় লেখা প্যালেস্টাইন, কোনওটায় আবার বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথা! কিন্তু টোটব্যাগের এই প্রতীকি বার্তা বা ‘সিম্বলিজম’কে ঘিরেই আপাতত উত্তাল ভারতের রাজনীতি।

বিতর্কের সূত্রপাত গতকাল সোমবার, যখন সকালে বিরোধী দল কংগ্রেসের এমপি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ‘প্যালেস্টাইন’ লেখা একটি টোটব্যাগ নিয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেছিলেন।

ব্যাগটায় ছিল তরমুজের ছবিও, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতির সূচক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত একটি প্রতীক।

গত মাসেই কেরালার ওয়েনাড আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো দেশের এমপি হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সেই আসনটি খালি হয়েছিল গত লোকসভা নির্বাচনে তার বড় ভাই রাহুল আমেথি ও ওয়েনাড, দুটি কেন্দ্রেই জিতে একটি ছেড়ে দেওয়ার পর।

নবীন পার্লামেন্টারিয়ান প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে এর আগের দিনই (রবিবার) ভারতে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি শার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার্স আবেদ এলরাজেগ আবু জাজের তার বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন। প্যালেস্টাইন লেখা ওই টোটব্যাগটি সম্ভবত তারই উপহার ছিল।

সে যাই হোক, প্যালেস্টাইন লেখা ব্যাগ নিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী পার্লামেন্টে আসার পর থেকেই তা নিয়ে প্রবল বিতর্ক দানা বেঁধেছে – কারণ বিজেপি-সহ শাসক জোটের দলগুলো এই পদক্ষেপকে ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি’ বলে তীব্র সমালোচনা করছে।

প্যালেস্টাইন লেখা টোটব্যাগ নিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ১৬ ডিসেম্বর

বিজেপি এমপি মনোজ তিওয়ারি অভিযোগ করেন, “কংগ্রেস বরাবরের মতো আবারও (মুসলিম) তোষণের রাজনীতিতে নেমেছে, প্রতীকি এজেন্ডা ব্যবহার করে তারা ভারতের ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে!”

আরও এক ধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী এস পি সিং বাগেল মন্তব্য করেন, “এটা কোনও কোইনসিডেন্স নয় যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দুম করে একটা প্যালেস্টাইন লেখা ব্যাগ নিয়ে পার্লামেন্টে চলে এলেন! ভারতের একটা বিশেষ শ্রেণির ভোটারদের মেরুকরণ করতেই ভেবেচিন্তে এটা করা হয়েছে।”

ঘরের পাশে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের জন্য সহানুভূতি না দেখিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কেন দূর মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তনি মুসলিমদের জন্য ‘দরদ’ দেখাচ্ছেন, এই প্রশ্নও তুলতে থাকেন বিজেপি মুখপাত্ররা।

কংগ্রেস কিন্তু এর জবাবে গতকাল কিছুটা রক্ষণাত্মকই ছিল।

দলের নেতা রাজীব শুক্লাকে যেমন বলতে শোনা যায়, “প্রিয়াঙ্কাজি তো জঙ্গি সংগঠন হামাসের প্রতি সহানুভূতি জানাননি, তিনি সংহতি প্রকাশ করেছেন গাজার নির্যাতিত মানুষদের প্রতি। প্রতিবাদ জানিয়েছেন সেখানে চালানো গণহত্যার।”

ভারতের বেশ কয়েকটি চ্যানেলে আবার প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর টোটব্যাগকে বিদ্রূপ করে ‘ভোটব্যাগ’ নামেও ডাকা শুরু হয়ে যায়!

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তার টোটব্যাগ নিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ১৭ ডিসেম্বর

বাংলাদেশের হিন্দু-খ্রীষ্টানদের প্রতি সংহতি

এই বিতর্কের রেশ ধরেই হোক বা অন্য যে কোনও কারণে, এদিন মঙ্গলবার সকালে পার্লামেন্টে কংগ্রেস এমপি-দের হাতে দেখা যায় নতুন এক ধরনের টোটব্যাগ – যাতে লেখা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কথা!

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী-সহ কংগ্রেসের এমপি-রা আজ দেশের নতুন পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবিতে তীব্র বিক্ষোভও দেখান।

বিক্ষোভের সময় তাদের সবারই হাতে ছিল সেই টোটব্যাগ, যাতে লেখা ‘স্ট্যান্ড উইথ মাইনরিটিস অব বাংলাদেশ’, মানে আমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে আছি।

ভারত সরকার বাংলাদেশে হিন্দু ও খ্রীষ্টানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুক এবং এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলুক – এই দাবিতে স্লোগানও দিতে থাকেন কংগ্রেস এমপি-রা।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, “আজেবাজে বিষয় নিয়ে বিতর্ক না করে সরকারের উচিত বাংলাদেশের হিন্দু ও খ্রীষ্টানদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। এর জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের কথা বলা প্রয়োজন।”

সংসদের অধিবেশনে জিরো আওয়ারেও তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কথা উত্থাপন করেন।

হিন্দু নির্যাতন বন্ধ করার দাবিতে ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ভারতে বিক্ষোভ

প্যালেস্টাইন লেখা টোটব্যাগকে তিনি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, এই অভিযোগের জবাবে কংগ্রেসের নতুন এই পার্লামেন্টারিয়ান বলেন, “আমি কী পরব সেটা সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্ত। আপনি কী ঠিক করে দেবেন আমার পরনে কী থাকবে?”

একজন নারী কী পরবেন বা তার হাতে কী থাকবে, সেটা অন্য কারও ঠিক করে দেওয়াটা ‘একদম পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ‘র পরিচয় বলেও দাবি করেন তিনি।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, শুধু টোটব্যাগ নয় – এবারে পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনে এমপি-দের জ্যাকেট বা টি-শার্টও কিন্তু রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

কংগ্রেস ও বিরোধী দলীয় এমপি-রা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও শিল্পপতি গৌতম আদানির কথিত আঁতাতকে আক্রমণ করতে ‘মোদী-আদানি এক হ্যায়’ লেখা জ্যাকেট ও টি-শার্ট পরে সংসদে এসেছেন।

ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থান কী?

দিল্লিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকে বলছেন, কংগ্রেস যে শুধু ফিলিস্তিনের মুসলিমদের পাশেই নয় – বাংলাদেশের হিন্দু ও খ্রীষ্টানদের পাশেও আছে এটা দেখাতেই আজ তড়িঘড়ি দলের পক্ষ থেকে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল।

তবে লক্ষণীয় বিষয় হল – ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো ও বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এ দুটোই কিন্তু ভারতের দীর্ঘদিনের ঘোষিত সরকারি নীতি।

এস জয়শংকর

মধ্যপ্রাচ্যে ভারত বহুকাল ধরেই একটি ‘টু-স্টেট সলিউশন’ বা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের থিওরিকে সমর্থন করে আসছে – যা ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে!

গত সপ্তাহেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর পার্লামেন্টে ভারত এই নীতিতে অবিচল আছে বলে জানিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিদের জন্য যে ১৩টি প্রস্তাব আনা হয়েছে তার ১০টিতেই ভারত সমর্থন দিয়েছে।

ভারত ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত হলেও হামাসকে বাদ দিয়ে যে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, তাদের সঙ্গেও ভারতের ঐতিহাসিক সুসম্পর্ক আছে। গত সোয়া বছরে ফিলিস্তিনিদের জন্য ভারত বিপুল পরিমাণ ত্রাণও পাঠিয়েছে।

অন্য দিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারতের সহায়তা ও ভূমিকার কথাও সুবিদিত।

বিগত দেড় দশক জুড়ে যখন শেখ হাসিনা ওই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ বলেও বর্ণনা করা হত।

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কলকাতায় একটি সমাবেশ। ২০১৮

কিন্তু গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষার প্রশ্নটি দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে চরম অস্বস্তির একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র সচিব এবং শাসক দল বিজেপির নেতারা – সবাই প্রকাশ্যে দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারকে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে।

এখন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস এমপি-রাও ঠিক একই দাবি জানালেন – তবে টোটব্যাগকে হাতিয়ার করে।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024