ম্যাকসিম গোর্কী
পঁয়ত্রিশ
মাঝে মাঝে তাঁকে দেখে মনে হয়, তিনি যেন কোনো দূর দেশ থেকে এই সবে মাত্র ফিরে এসেছেন-সে দেশের মানুষে অনুভব করে চিন্তা করে অন্য রকমে, সে দেশের মানুষের ভাষা এবং সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তখন তিনি ক্লান্ত বিবর্ণভাবে ঘরের একটি কোণে বসে থাকেন। মনে হয়, যেন অন্য কোনো পৃথিবীর ধূলোয় তাঁর সর্বাংগ ভরে আছে। তখন তিনি কোনো বিদেশী বা বোবার দৃষ্টিতে সকল কিছুকেই মনো- যোগের সংগে লক্ষ্য করতে থাকেন।
গতকাল মধ্যাহ্নভোজনের পূর্বে তিনি ঠিক ঐ ভাবে ঘরে এলেন।
তাঁর মন যেন কোন সুদূরে পড়ে আছে। তিনি একটা সোফায় ব’সে এক মুহূর্ত নীরব থাকলেন, তারপর, দেহটাকে ঈষৎ দুলিয়ে জানুর উপর হাতের তলা ঘসে সারা মুখে ভাঁজ ফেলে বললেন:
“কিন্তু তবুও সেটাই তো সব নয়-সব নয়।”
চেপ্টা লোহার মতন ভোঁতা বুদ্ধি কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন ক’রে বসলো:
“আপনি কী বলছেন?”
তিনি তার দিকে একদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আমি তখন ডক্টর নিকিটিন এবং ইয়েলপাটিয়েভ স্কির সংগে চত্বরে বসে ছিলাম। এবার তিনি আমাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন:
“তোমরা কি সম্বন্ধে আলাপ করছ?”
“প্লেহ ভ।”
“প্লেহ ড…. প্লেহভ…” তিনি একটু থেমে চিন্তাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, যেন নামটা এর আগে আর কখনো শোনেন নি। তার পর নিজেকে পাখীর মতো ঝেড়ে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন:
“আজ শেষ রাত্রি থেকে কেবলই একটা বাজে কথা আমার মাথার ভেতর দাপাদাপি ক’রে বেড়াচ্ছে; একবার কেউ আমাকে বলেছিল, সে নাকি কোনো কবরে এমনি একটি স্মৃতি-কথা লেখা থাকতে দেখেছে:
‘এই পাথরের নিচে বিশ্রাম করছেন ইভান ইয়েগরিভ।
পেশায় ছিলেন তিনি চামার; সর্বদাই ভেজাতেন চামড়া।
তাঁর কাজে ছিল সততা, মনে ছিল শুদ্ধি, কিন্তু, তবু দ্যাখো তাঁকেও যেতে হোলো; তাঁর কারবার প’ড়ে রইলো তাঁর স্ত্রীর কাছে।
এখনো তাঁর বাধক্যের ছিল দেরী, এখনো তিনি করতে পারতেন অনেক কাজ; কিন্তু ভগবান তাঁকে এক রাত্রে… শুক্রবার আর শনিবারের মাঝে…
নিয়ে গেলেন স্বর্গের জীবনে….’
এই ধরণের আরো কিছু……”
টলস্টয় নীরব হলেন। তারপর মাথা নেড়ে অস্পষ্ট মৃদু হাসি হেসে বললেন:
“মানুষের মুঢ়তা, যদি তা ঈর্ষা প্রণোদিত না হয়, তবে তার মধ্যে এমন কিছু থাকে, যা মর্মস্পর্শী, যা অতীব মনোরম।… আর সেটুকু সর্বদা থাকেই।”
এমন সময় আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজনের ডাক এলো।
Leave a Reply