শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৮:৫০ পূর্বাহ্ন

মুচলেকা দিয়ে যশোরের মাদ্রাসায় ‘জঙ্গি নাটকের’ অবসান

  • Update Time : শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.১৬ এএম
যশোরের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দাবি, ভিডিওতে যা দেখা গেছে তা মাদ্রাসার ছাত্রদের অভিনয়-দৃশ্য

হারুন উর রশীদ স্বপন

মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দাবি, ভিডিওতে যা দেখা গেছে তা মাদ্রাসার ছাত্রদের অভিনয়-দৃশ্য৷ তবে কাজটি যে ঠিক হয়নি, ডয়চে ভেলের কাছে স্বীকার করেছেন তারা৷ এমন আর কখনো করা হবে না- এই মর্মে থানায় মুচলেকা দিয়েছেন বলেও দাবি তাদের৷

যশোরের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি ভিডিও নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে দু’ দিন ধরে৷ ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিকে অবশ্য স্রেফ ছাত্রদের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ অনুষ্ঠানের অংশ বলে দাবি করেছেন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী। তবে এমন কাজ করা ঠিক হয়নি জানিয়ে ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গত ১৭ ডিসেম্বর মাদ্রাসার বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় মাস্টার্স লেভেলের শিক্ষার্থীরা এ নাটিকাটি মঞ্চায়ন করে বলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দাবি৷ তবে ওটা কোনো নাটকের অনুষ্ঠান ছিল না। সেদিন ছাত্ররা ‘প্রতিযোগিতামূলকভাবে’ তাদের বিভিন্ন ধরনের ‘প্রতিভা’ তুলে ধরেন বলে জানান মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী। তিনি জানান, সেদিন মূলত হামদ, নাত ও উপস্থিত বক্তৃতা হয়েছে, ওসবের সঙ্গে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ও হয়েছে।

তার কথা, “আর যেটি ভাইরাল হয়েছে, সেখানে জঙ্গি বা হামাস সদস্য নয়, ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনয় দেখানো হয়। তার কথা, “ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের কথা বলা হয়েছে, তাদের পক্ষে থাকার কথা বলা হয়েছে আরবি ভাষায়।”

প্রায় ছয় মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায় একজন বক্তা একটি ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে আরবিতে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখছেন। তার মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা, শুধু চোখ দেখা যায়। তার দুই পাশে কালো পোশাক পরা ও কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা দুইজন অস্ত্রধারী। ভিডিওর মাঝে স্লোগানও আছে। বক্তব্য শেষে বক্তার নেমে যাওয়ার সময়ও স্লোগান দেয়া হয়। মঞ্চের পিছনে মাদ্রাসার নাম লেখা ব্যানারও দেখা গেছে।

যশোরের জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দাবি ছাত্ররা না জানিয়ে এমন চরিত্রে অভিনয় করেছে৷ তিনি বলেন, “আসলে আমাদের আগে জানানো হয়নি তারা এই ধরনের অভিনয় করবে। আর প্রতিযোগিতার কারণে প্রতিযোগীরা বিষয় গোপন রাখে। আমাদের আসলে ভুল হয়ে গেছে। আমাদের আগেই বলে দেয়া উচিত ছিল কোন ধরনের অভিনয় করা যাবে, কোনটা যাবে না।”

মাদ্রাসার বার্ষিক অনুষ্ঠানের এমন আয়োজন ছাত্রদের মধ্যে উগ্রবাদ ছড়াতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তা হতে পারে। তবে ভবিষ্যতে আর এরকম ভুল আমরা করবো না। আর ওই ধরনের ডামি অস্ত্র নিয়ে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার তো কোনো দরকার নেই। ওটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ছাত্ররা ভুল করে ফেলেছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মাদ্রাসায় নাটক হয় না, অনুমতিও দেয়া হয় না। যেটা হয়েছে সেটা নাটক নয়, ওটা যেমন খুশি তেমন সাজো। আর এই ধরনের ঘটনা অতীতে কখনো হয়নি।”

মাদ্রাসার সচিব মুফতি মাগফুরুর রহমানের কাছে ভিডিওটির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আসলে ওটা ছিল ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হচ্ছে, তার ওপরে একটি অভিনয়। বাস্তব কিছু নয়। অস্ত্র বানানো হয়েছে শোলা দিয়ে। পোশাক বানানো হয়েছে পর্দার কালো কাপড় দিয়ে।”

তিনিও দাবি করেন, তারা জানতেন না যে এই ধরনের অভিনয় দেখানো হবে। তিনি বলেন, আরো অনেকে অভিনয় দেখিয়েছে, তাতে কোনো সমস্যা ছিল না, শুধু এই একটা ভিন্ন আঙ্গিকে করা হয়েছে।

ছাত্ররা না জানিয়ে যদি করে থাকে, তাহলে এমন কথিত ‘অভিনয়’ শুরুর পর কেন বন্ধ করা হলো না জানতে চাইলে এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

উল্লেখ্য, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তথাকথিত ‘যেমন খুশি সাজো’ হয়ে থাকলেও পারফর্মারদের বাধা তো দেয়া হয়ইনি, বরং পুরো বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর ‘পারফর্মাররা’ যখন মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন, উপস্থিত সবাই তাদের বাহবা দিচ্ছিলেন।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলন বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে বেছে না নিয়ে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে তারা প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে হামাস বা ফিলিস্তিনী যোদ্ধাকে বেছে নিলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অভিনয়গুলো আরবিতে। আরবি ভাষার সঙ্গে ফিলিস্তিনের ঘটনার বর্ণনা মিলে যায়। সেই কারণেই হয়তো তারা এটা করেছে। এর ভিতরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই।”

ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর বুধবার রাতেই যশোর কোতোয়ালী মডেল থানার পুলিশ ওই মাদ্রাসায় গিয়ে কালো কপড়ের পোশাক এবং ‘নকল’ আগ্নেয়ান্ত্র এবং তৈরির উপাদান জব্দ করে। মাদ্রাসার সচিব মুফতি মাগফুরুর রহমান এবং কয়েকজন ছাত্রকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, “আমরা জব্দ করা আলামত ও তাদের জিজ্ঞাসবাদে নিশ্চিত হয়েছি যে, আসলে ওটা ছিল নাটক৷” তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘‘একটি অনুষ্ঠানে ডামি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে উগ্রবাদীদের মতো পোশাক পরে ওই নাটক করা হয়। এর অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তবে কাজটি ঠিক হয়নি। এতে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়।” তিনি আরো বলেন, ‘‘তারা (মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা) ভবিষ্যতে এইরকম আর করবে না মুচলেকা দেয়ায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।”

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের কাছে মাদ্রাসায় এমন অনুষ্ঠান করার জন্য অনুমতি নেয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাধারণত স্কুল,কলেজ বা মাদ্রাসার এই ধরনের সাংস্কৃতিক বা খেলাধূলার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে অনুমতি লাগে না।”

মাদ্রাসার সচিব জানান, অনুষ্ঠানটি ছিল ‘নিজেদের মধ্যে’, বাইরের কোনো অতিথি সেখানে ছিলেন না।

তিনি বলেন, “আমাকে ও ছাত্রদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমাদের কথা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে বলেই পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।”

যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের রাজার হাটে মাদ্রাসাটি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হাটহাজারি ও দেওবন্দের কওমী ঘরানার মাদ্রাসা বলে জানান মাদ্রাসাটির প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী। তিনি নিজেই এর প্রতিষ্ঠাতা। এখানে  পবিত্র কোরান, হাদিস শিক্ষা ছাড়াও আরবি লাইনে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ানো হয়।  এছাড়া ইসলামী আইনের ওপর ডিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়। বর্তমানে ৫০০ শিক্ষার্থীর এই মাদ্রাসাটি বাংলাদেশ কওমী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে।

ওই বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু বলেন,” আমি ওই ভিডিওটি দেখিনি। তারপরও বলছি আমাদের অধীনে মাদ্রাসাগুলোর নির্দিষ্ট পাঠক্রম আছে। আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলারও নীতিমালা আছে। আমাদের নাটকও আছে তবে তা শরিয়তের মধ্যে থেকে। শরিয়তের খেলাপ হয় এমন কিছু আমরা অনুমোদন করিনা।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,” উগ্রবাদ বা অশান্তি ছাড়াতে পারে এমনকিছু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সেই ধরনের কোনো পাঠক্রম, নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমোদ নাই। এরকম কিছু হয়ে থাকলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।”

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024