সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৪৯ অপরাহ্ন

ফজলে হাসান আবেদ: বাঙালির একটি মুর্তি

  • Update Time : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১১.১৫ পিএম

স্বদেশ রায় 

২০ তারিখ ছিলো স্যার ফজলে হাসান আবেদের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী। যদিও দিনটি পার হয়ে গেছে তারপরেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো কর্তব্য। বিশেষ করে জাতি হিসেবে আমরা এমন একটা সময়ে ধীরে ধীরে চলে এসেছি- যখন আমরা আমাদের বড় বড় সকল মুর্তিগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে জাতি হিসেবে নিজেদেরকে খর্বাকৃতি বামনে পরিণত করার দিকে এগিয়ে চলেছি। তাই এ জাতি যদি ফজলে হাসান আবেদকে স্মরণ না করে তা হলেও ফজলে হাসান আবেদের কোন ক্ষতি নেই তবে ভবিষ্যতে আরেকজন ফজলে হাসান আবেদ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে না।

ফজলে হাসান আবেদ আর ব্রাক সমার্থক শব্দ। তাই ফজলে হাসান আবেদের কথা উঠলেই সামনে চলে আসে ব্রাক। সাধারণ ভাবে অনেকেই মনে করতে পারেন ব্রাক মানে তো একটা এনজিও। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের কাছে এনজিও’র ভাবমুর্তি খুব ভালো না। এমনকি এটা অনেকে এক ধরনের ভদ্রলোকদের চাতুরি ব্যবসা বলেও মনে করেন। রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক বদরুদ্দিন ওমরের এ নিয়ে অনেক লেখাও আছে। যতদূর মনে পড়ছে বদরুদ্দিন ওমরের একটা গবেষণা মূলক বইও আছে এ নিয়ে। তাছাড়া দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে অনেক এনজিও’র ভেতর বাইরে দেখার সুযোগ হয়েছে।

তেমনি দেখার সুযোগ হয়েছে ব্রাককে। ৭০ এর দশকের শেষের দিকে এই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল অনেক বেশি ঘুরতে হয়েছিলো। সেই সময়ে বর্ষায় কাঁদায় গ্রামের রাস্তা ঘাটের কী অবস্থা ছিলো তা আজ বাংলাদেশের কোন সন্তান কল্পনাও করতে পারবে না। সেই সব রাস্তায় সাদা শাড়ি পরা ব্রাকের নারী কর্মীদের সঙ্গে দেখা হতো। কাঁদা মাড়িয়ে, কখনও ছাতা থাকতেও শাড়ী ভিজিয়ে তারা মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতেন।

১৯৭১ সালে শরনার্থী শিবিরে শরণার্থীদের ডায়েরিয়া থেকে বাঁচাতে যে ওরস্যালাইন ব্যবহার শুরু হয়েছিলো অর্থাৎ একমুট গুড়, এক চিমটি লবন ও এক গ্লাস পানি। ( এখানে যদিও খুব প্রাসঙ্গিক নয় তারপরে বলতে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদের এই ওর স্যালাইনের ফর্মুলা ভিন্ন কারণে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। আর তার মুলে ছিলো দুই বারের ডাকসু ভিপি ও তিন বারের ডাকুস’র জি এস আখাতারুজ্জামানের একটি বিখ্যাত বক্তৃতা। তিনি সে সময়ে বার বার যে সকল কিংস পার্টি গঠিত হতো তাদের নিয়ে বলতেন, “ওই যে ওরস্যালাইন বানানোর ফর্মুলা আছে না, একমুট গুড়, এক চিমটি লবন আর এক গ্লাস পানি- এ পার্টি গুলোও একই ভাবে তৈরি হচ্ছে, এক মুট সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য, এক চিমটি মুক্তিযোদ্ধা ও এক গ্লাস রাজাকার”। তার বিখ্যাত বাচন ভঙ্গীতে এ শুনতে শুনতে আর যাই না হোক ওর স্যালাইন তৈরির ফর্মুলা সেদিন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা জেনে গিয়েছিলো।)

৭০ এর দশক থেকে শুরু করে ৮০’র দশকে এসে বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডায়েরিয়ার মৃত্যুর হার কমে আসে। আর এর সব থেকে বড় কৃতিত্ব ব্রাকের।

এর পরে আশির দশকে এসে দেখলাম ব্রাকের আরেক ধরনের সাদা শাড়ি পরা মেয়েদের। প্রায় প্রতিটি গ্রামে গ্রামে তাদেরকে দেখতাম। তারা একাই একটি প্রাথামিক স্কুল চালাতো। এক শিক্ষকের স্কুল। তাদের এই স্কুল ঝড় বন্যায়ও বন্ধ থাকতো না। ‘৯৮ এর প্রবল বন্যায়ও মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদি প্রভৃতি এলাকায় তাদের এই স্কুল চালু থাকতে দেখেছি। আর সাংবাদিক হিসেবে খোঁজ নিয়ে দেখেছি এই স্কুলগুলোর মাধ্যমে যে সব পরিবারের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছে তাদের অন্য কোনভাবে শিক্ষা পাবার কোন উপায় ছিলো।

ব্রাকের সৃষ্টি হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হাসান আবেদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটি ধ্বংস প্রাপ্ত দেশ গড়ার একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকা আজ এ প্রজম্ম হয়তো জানে না। তাই অনেকে শুধু স্যার ফজলে হাসান আবেদকে চেনে, অনেকে ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদকে চেনে- কিন্তু এ প্রজম্ম খুবই কম জানে মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হাসান আবেদকে। এমনকি তারা জানেও না মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংস প্রাপ্ত গ্রামে ত্রান দিতে গিয়েই তার এই ব্রাক সৃষ্ঠির ভাবনা আসে তাঁর। এবং বাঙালির মাতৃসমা কবি, সুফিয়া কামালকে সভাপতি করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করান।

তারপরে সময়ের বির্বতনে ব্রাকের একটা অংশকে তিনি এনজিও থেকে অনেকটা কর্পোরেটে নিয়ে যান। আধুনিক ব্যাংকিং, বিশ্ববদ্যিালয় থেকে শিশু খাদ্য’র ব্যবসায় ব্রাক প্রবেশ করে। তেমনি গ্রামের মহিলা ও স্বভাবজাত ও বংশগতির ধারার চারু ও কারু শিল্পিদের কাজে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেন আড়ং। আড়ং নিয়ে এক কথায় বলা যায়, আড়ং এর পণ্য নিয়ে বিদেশে বা বিদেশীদের কাছে যেখানে যাওয়া  হোক না কেন, মূলত এক টুকরো বাংলাদেশকেই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। বাস্তবে আড়ং এর একটা পণ্য ব্যবহার করলে বা একটা পোষাক পরলে তার ভেতর নিজ দেশের একটা গন্ধ মেখে থাকে।আবহমান বাংলার ছন্দ কোথায় যেন খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ প্রথা হাজার হাজার বছর ধরে ছিলো। এখনও নানাভাবে আছে। তবে এনজিও হিসেবে এটা শুরু করে ব্রাক। তাদের কাজের ভেতর দিয়ে বা ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝেছি, তিনি ঋনের থেকে কর্মসংস্থানের প্রতি এবং মানুষকে কর্মী তৈরি করা ও আধুনিক কর্পোরেট এর সঙ্গে জড়ানো এবং উন্নত শিক্ষা দেবার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

সাংবাদিকতা জীবনে ফজলে হাসান আবেদের দুটি কি তিনটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি। একটা নিয়েছিলাম প্রায় সারাদিন ধরে। তিনি সাক্ষাৎকারের মাঝে মাঝে তাঁর কয়েকটি মিটিং ও সেরে এসেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারটি নেবার সময় যে একটি ভিন্ন আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলাম তা এখনও যেন নিজের স্মৃতিতে জীবন্ত। নানান প্রশ্নের এক ফাঁকে এসেছিলো, তাঁর প্রিয় কবি প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, সিমাস হিনি। আমারও অন্যতম প্রিয় কবি হিনি। কিন্তু তাকে তা না জানিয়ে তার কাছ থেকে সিমাস হিনিকে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। সেদিনের আলোচনায় সিমাস হিনি’র অনেকগুলো কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। মনে হচ্ছিলো যেন সচিত্র সন্ধানির সেই আড্ডায় বসে আছি যেখানে, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপধ্যায়, বেলাল চৌধুরি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন, রফিক আজাদ প্রমুখ এমনকি সলিল চৌধুরিও কবিতা নিয়ে আলাপ করেছেন।

আসলে ফজলে হাসান আবেদের ওই দিনের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আবারও উপলব্দি হয়, পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ থাকে- এক ধরনের মানুষ খুব নিপুন ডিজাইন করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যান ক্যারিয়ারকে। আরেক ধরনের মানুষ একটি কবি মন নিয়ে সৃষ্টিশীলতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যান। রেখে যান পৃথিবীতে তার সৃষ্টি। ফজলে হাসান আবেদ এই শেষের দলের মানুষ। আর এই ধরনের মানুষদের কাজে হয়তো ভুল হয় কখনও কখনও কিন্তু তাদের সততা নিয়ে জীবনে কোন প্রশ্ন ওঠে না।

ব্রাক ও ফজলে হাসান আবেদের এই সততার একটি ছোট উদাহরণ খুঁজে পাই সাংবাদিকতার ভেতর দিয়েই। ২০০৯ সালে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে ওই সময়ের সরকার বিনা সুদে কৃষকদের ১৫’শ কোটি টাকা ঋণ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষকদের এ ঋণ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমেই দেয়ার কথা। কিন্তু ওই সময়ের কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালিদ ভাই ফোন করে বললেন, আমি যেন একটু খোঁজ নেই এই ঋণ দেয়ার দ্বায়িত্বটি কৃষি ব্যাংককে না দিয়ে কেন ব্রাকের মতো একটি এনজিওকে দেয়া হলো।

কয়েকদিন খোঁজ খবর নিয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, ওই সময়ের সরকার প্রধানের নির্দেশে কৃষিমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভণরকে জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার প্রধান চান এই ঋণ ব্রাকের মাধ্যমে দেয়া হোক।

সরকার কেন এনজিও’র মাধ্যমে তাদের ঋণ দিচ্ছে বিষয়টি ইব্রাহিম খালিদকে বেশ ভাবায়। তাই তিনি নিজে এর খোঁজ নেবার চেষ্টা করেন। এবং কয়েকদিন পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানান, সরকার প্রধান হিসেব করে দেখেছেন, ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দিলে সবটুকু টাকা কৃষক পাবে না। মাঝখানে মিডল ম্যানের হাতে সামান্য অংশ হলেও চলে যাবে। কিন্তু ব্রাকের মাধ্যমে দিলে কৃষক সবটুকু পাবে।

ইব্রাহিম খালিদ ভাই এর কাছে একথা শুনে ফেরার পথে মনে পড়ছিলো ফজলে হাসান আবেদের মুখে সেই কবিতার লাইনগুলো আর তার ব্যাখা। পাশাপাশি মনে হয়,  তাঁর নিজের বিশাল পারিবারিক ঐতিহ্য, দেশপ্রেম সর্বোপরি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার চেতনা ও দেশের প্রতি দায়বোধ তাকে কত উচ্চতায় নিয়ে গেছে।  আমাদের মতো একটা পশ্চাদপদ দেশে এমন উচ্চতার একজন আধুনিক মানুষকে তাই আগামী দিনের জন্যে একটি ভদ্র ও শিক্ষিত প্রজম্ম গড়তে অবশ্যই স্মরণ করা দরকার। দরকার ফজলে হোসেন আবেদকে নিয়ে চর্চা করার।

লেখকঃ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024