শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯৮)

  • Update Time : শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০.৫৮ এএম

সন্ন্যাসী ঠাকুর

পরদিন নানা কুৎসা করিয়া সেই লোক দুইটি কোর্টে যাইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের নামে এক মামলা দায়ের করিয়া দিল। ইহা লইয়া সারা শহরে ঢি ঢি পড়িয়া গেল। সন্ন্যাসী ঠাকুরের নামে তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষীয়েরা নানারকম কুৎসা প্রচার করিতে লাগিল। তখনকার দিনে ফরিদপুর হইতে ‘সঞ্জয়’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বাহির হইত। সেই পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে সন্ন্যাসী ঠাকুরের নামে স্ত্রীলোক-ঘটিত নানা কল্পিত কাহিনী প্রচার করিতে লাগিল। কোনো ভালো লোকের নামে কেহ কুৎসা রটাইলে লোকে সহজেই তাহা বিশ্বাস করে। মামলায় সন্ন্যাসী ঠাকুর খরচাসহ ডিক্রি পাইলেন। কিন্তু তাঁহারা ভক্তগোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন কমিতে লাগিল। আগে যেখানে প্রতিদিন শহর হইতে ভারে ভারে মিষ্টি ও খাবার নানা-রকম সামগ্রী আসিত, এখন তাহার কিছুই আসে না। বিহারীলাল নামে সন্ন্যাসী ঠাকুরের এক শিষ্য প্রতিদিন দুইবেলা নিয়মিত খাবার পাঠাইতেন। স্ত্রীর প্রতি কি অত্যাচার করায় সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহার খাবার বর্জন করিলেন।

এখন প্রতিদিন তিনি চিড়া ভিজাইয়া তাহাই চিনি অথবা কলা দিয়া খাইতেন। তাহারও কিছুটা জোর করিয়া আমাকে খাওয়াইতেন। অল্প আহারে দিন দিন তাঁহার শরীর শুকাইয়া যাইতে লাগিল। তিনি যাহাকে-তাহাকে শিষ্য করিতেন না। বাছিয়া বাছিয়া যাঁহাদিগকে শিষ্য করিতেন তাঁহাদিগকে প্রতিদিন তাঁহার আশ্রমে আসিয়া যোগ-সাধনা অভ্যাস করিতে হইত। তাঁহারা নিয়মিত না আসিলে তিনি বড়ই রুষ্ট হইতেন। আমি ছোট বলিয়া আমাকে তিনি কোনো যোগ-সাধনা শিখান নাই। মাত্র কয়েকটি মুদ্রা ও ধ্যান শিখাইয়াছিলেন। আস্তে আস্তে শিষ্যেরাও আর যোগ-সাধনা করিতে আসে না।

তিনি নিজে যোগ-সাধনা করিতেন আর অবসর পাইলে বই পড়িতেন। তাঁহার নিকট ‘উৎসব’ আর ‘ব্রহ্মাবিদ্যা’ নামে দুইখানা মাসিকপত্র আসিত। রামবাবু নামে এক ভদ্রলোক ‘উৎসবে’র সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীকালে এই রামবাবুর নিকট নজরুল ইসলাম’ যোগ শিক্ষা করিয়াছিলেন। ‘ব্রহ্মবিদ্যা’র সম্পাদক ছিলেন পরলোকগত দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বৎসর শেষ হইলে এই পত্রিকা দুইখানা তিনি দপ্তরি দিয়া বাঁধাইয়া লইতেন। তাঁহার নিকট আরও অনেক বই ছিল।

সবই দর্শনশাস্ত্রের উপর। ‘ধর্ম-পূজা মীমাংসা’ বলিয়া একখানা বই তিনি আমাকে পড়িতে দিয়াছিলেন। সেই পুস্তকে অনেক উপদেশ লিখিত ছিল।

ইতিমধ্যে একটি কাণ্ড ঘটিল। একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর রাতে শুইয়া আছেন। তাঁহার ঘরের দরজা বন্ধ। এমন সময় একটি লোক তাঁহার বুকের উপর বসিয়া তাঁহার সারাগায়ে ফুঁ দিতে লাগিল। সেই ফুঁয়ের সঙ্গে গাদা গাদা আগুন সন্ন্যাসী ঠাকুরের গায়ে পড়িতে লাগিল। তারপর লোকটি অদৃশ্য হইয়া গেল। এই কাহিনী শুনিয়া শিষ্যেরা বলিল, “মা কালী তাঁর চর পাঠাইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরকে পরিশুদ্ধ করিয়া গেলেন।”

রাত্রকালে মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী ঠাকুর শ্মশানের শেওড়া গাছটির সামনে নদীর দিকে মুখ করিয়া একটি মেয়েকে বসিয়া থাকিতে দেখিতেন। তাঁর পরনে সাদা ধবধবে বসনের মতোই তাঁহার গায়ের রং ফর্সা। তিনি নাকি একটি ব্রাহ্মণ-কন্যা। সকাল হইবার আগেই তিনি আকাশে ভাসিয়া অদৃশ্য হইয়া যাইতেন। সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে মাঝে মাঝে তাঁহার আলাপও হইত। এইসব কাহিনী শুনিয়া মাঝে মাঝে আমার সামান্য ভয়ও করিত।

শ্মশানঘাটে শহর হইতে বহু লোক মড়া পোড়াইতে আসিত। একবার একটি অল্প বয়সের বউকে পোড়াইতে আনিয়াছে। অপরিণত বয়সে সন্তান হওয়ার সময় মেয়েটি মারা যায়। দেখিতে মেয়েটি কতই সুন্দর। দু’টি পায়ে দবদব করিতেছে আলতার রং আর কপাল ভরিয়া লাল সিন্দুর। বউটিকে যখন চিতার উপর তুলিয়া দেওয়া হইল কোথা হইতে আমার দুই চোখ বাহিয়া জল গড়াইতে লাগিল।

 

চলবে…

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024