মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৬:১০ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০০)

  • Update Time : রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০.৫৮ এএম

সন্ন্যাসী ঠাকুর

দুঃখ-বিপদের পথে যে রোমাঞ্চ আছে আমার সেই বালকবয়সে তাহার আকর্ষণ আমার কাছে কম লোভনীয় নয়। বলিলাম “আমি পিছপা হইব না। আপনার সঙ্গে থাকিতে কোনো বিপদ-আপদই আমাকে উলাইতে পারিবে না।”

সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিলেন, “তোমাকে ভয় জয় করিতে হইবে। কোনো-কিছুতেই কিন্তু ভয় পাইলে চলিবে না।”

আমি বলিলাম, “আপনি যেরূপ আদেশ করিবেন সেরূপই করিব।”

তখনও সন্ন্যাসী ঠাকুরের যাত্রা করিবার তিনদিন মাত্র বাকি ছিল। আমি এই তিনদিন নানাভাবে কান্নাকাটি করিয়া তাঁহার স্নেহপ্রবণ হৃদয়ে আরও আঘাত হানিব এই ভয়েই তিনি আমাকে মিথ্যা করিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন, অথবা সত্য-সত্যই তিনি আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন আজ সেকথা ভালো করিয়া বলিতে পারিব না।

আর তিনদিন মাত্র বাড়ি থাকিব। তাই এই তিনদিন পিতামাতার বড়ই বাধ্য হইয়া উঠিলাম। ভাত রাঁধিতে মায়ের লাকড়ির কষ্ট। এখান-ওখান হইতে গাছের শুকনা ডালপালা আনিয়া মাকে দেই। বাড়ির গরু দুইটিকে মাঠ হইতে ঘাস কাটিয়া আনিয়া দেই। মা ও বাজান অবাক হইয়া যান। রাত্রে ঘুমাইয়া সেই সুদূর হিমালয়ের স্বপ্ন দেখি, আমি যেন লছমনঝোলার সেতু পার হইয়া কেদার বদরী ছাড়াইয়া অনেক-অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছি।

নিদিষ্ট দিনে আমি টেপাখোলা রেলস্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর যে-গাড়িতে উঠিলেন আমিও সেই গাড়িতে উঠিয়া এককোণে বসিয়া রহিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরের শিষ্যেরা, ভক্তেরা সকলেই তাঁহাকে বিদায় দিবার জন্য স্টেশনে আসিয়াছেন। তাঁহারা কেহ কাঁদিতেছেন, কেহ সন্ন্যাসী ঠাকুরকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে নানারকম অনুরোধ-উপরোধ করিতেছেন। আমি তো সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গেই চলিয়াছি। আমার মন এক অপূর্ব আনন্দে ভরপুর।

গাড়ির যখন প্রথম ঘণ্টা বাজিল তখন সকলের দৃষ্টি আমার উপর পড়িল। জলধর-দাদা মোক্তার মানুষ। আইন-কানুন জানেন। বালকবয়সে আমাকে লইয়া গেলে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে বিপদে পড়িতে হইবে। তিনি আমাকে বলিলেন, “একি জসীম। তুমি শিগগির নামিয়া আস, গাড়ি এখনই ছাড়িবে।” আমি বলিলাম, “আমার তো নামিবার কথা নয়। আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে যাইব।”

সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে কাছে ডাকিয়া কত বুঝাইলেন, “তুমি বড় হও। আবার আমি আসিয়া তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। এতটুকু বয়সে তুমি কিছুতেই সেই পথের কষ্ট সহ্য করিতে পারিবে না।” আমি কিছুতেই গাড়ি হইতে নামি না। তখন দুই-তিনজন শিষ্য আমাকে জোর করিয়া গাড়ি হইতে নামাইয়া দিলেন। আমি প্ল্যাটফর্মে নামিয়া গাড়ির ইঞ্জিনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইতে লাগিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরকে আমি এত ভক্তি করি-ভালোবাসি, তাঁর জন্য আমি কত কঠোর অত্যাচার সহ্য করি। আজ তিনিই যদি এমন করিয়া আমাকে ছাড়িয়া গেলেন তবে এ-জীবনে আমার কি প্রয়োজন?

সন্ন্যাসী ঠাকুরের গাড়ি যখন ছাড়িবে, আমি তার চাকার তলায় পড়িয়া আত্মহত্যা করিব। আমি গাড়ির ইঞ্জিনের দিকে অগ্রসর হইতেছি এমন সময় তিন-চারজন শিষ্য আমাকে সন্ন্যাসী ঠাকুরের নিকট ধরিয়া লইয়া গেল। তিনি আমাকে গায়ে-মুখে হাত বুলাইয়া কত সান্ত্বনা দিলেন। তখন আমার অশ্রু-সাগরে বান ডাকিয়াছে। আমি ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরের গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মনে হইল আমার এতকালের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সবই যেন সেই গাড়ির চাকার ওলায় পড়িয়া চুরমার হইয়া গেল। জলধর-দাদা আমাকে বলিলেন, “কাল সকালে তুমি তালায় বাসায় আসিও।

 

চলবে…

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024