বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:২৭ অপরাহ্ন

বাঙালি “হিন্দু- তরুণ” প্রজম্মের জাগরণকে অস্বীকার করা কি সঠিক হচ্ছে?

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯.০২ এএম

স্বদেশ রায় 

পূ্র্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিন নামে গত প্রায় ৮ দশক এই ভূখন্ড পরিচিত হয়েছে। এই সময়ের সকল উত্থান পতনের সঙ্গে যেমন বাঙালি হিন্দু জড়িত আছে তেমনি এই ৮ দশক ধরেই বাঙালি হিন্দু এই ভূখন্ড ত্যাগ অব্যাহত রেখেছে। এর প্রথম ৬ দশক ছিলো আগে ভারতে মাইগ্রেশান করা তার পরে তাদের কয়েকটি শ্রেণীর পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে পড়া। গত দুই দশক  ধরে অনেকে সরাসরি এখান থেকেই ভারতে না গিয়ে তার সুবিধামত পৃথিবীর অনান্য দেশে চলে যাচ্ছে। আর বড় অংশ ভারতে চলে যাচ্ছে। এর প্রায় সবটুকুই ঘটেছে নীরবে। বিশেষ করে ষাটের দশকের পর থেকে সবই ঘটছে নীরবে। হিসাব করলে বাঙালির হিন্দুর এই মাইগ্রেশান পৃথিবীর নীরব মাইগ্রেশানের  অন্যতম।

এই মাইগ্রেশান ঠেকানোর জন্যে এই ভূখন্ডের কোন সরকারের বা কোন সংগঠনের বা কোন সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিত্বদের কোন উদ্যোগ কখনও দেখা যায়নি। বরং এটাই বাস্তবতা ধরে নেয়া হয়েছে যে হিন্দুরা এখান থেকে চলে যাবে। এমনকি এই ভূখন্ডের বাঙালি হিন্দুদের  অধিকাংশের মনোজগতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এটাই বাস্তবতা বলে কাজ করে।

এই মনোজগত ও এই বাস্তবতার বিপরীতে ২০২৪ এ আগষ্ট পরবর্তী পট পরিবর্তনের পর এবারই প্রথম দেখা গেলো বাঙালি হিন্দুরা এ দেশে থাকতে চায়- তাদেরকে অত্যাচার করে, তাদের ওপর সরব ও নীরব নিপীড়ন করে তাড়ানো না হয়- এ জন্য তারা রাস্তায় নেমেছে। বাঙালি হিন্দুদের এই রাস্তায় নামা ও এদেশে থাকতে চাওয়ার এই আন্দোলনটি দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপরে নানানভাবে বলা হতে থাকে, এটা মূলত একটি রাজনৈতিক দলের ইন্দনে, তাদের সমর্থনে এ কাজটি হচ্ছে- তখন আরো বেশি বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, এই ভূখন্ডের বাঙালি হিন্দু চরিত্রে এই বিষয়টি আমি দেখিনি। কারণ, কোন বই না লিখলেও দেশভাগ ও উদ্বাস্তু নিয়ে  গভীর আগ্রহ থাকায় এ নিয়ে সাধ্যমত পড়াশুনা, সরেজমিন দেখা ও বিভিন্ন জেনারেশানের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলছি প্রায় গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

 

এই নিজস্বধারায় জানার ভেতর দিয়ে এই মাইগ্রেশানের বেশ কতকগুলো দিক বা চরিত্র চিহ্নিত করেছি নিজের মতো করে। যেমন ১৯৪৬ এর শেষ এর দিক থেকে পঞ্চাশের দশক পুরো সময়টি বাঙালি হিন্দুর যে উচ্চ শিক্ষিত অংশটি এ দেশ ত্যাগ করে তাদের বড় অংশ অত্যাচারের ভয়ে এ দেশ ত্যাগ করেনি। ১৯৪৬ এ পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা পেলে বাঙালি হিন্দুর উচ্চ শিক্ষিত একটি শ্রেণী তখনই ধরে নিয়েছিলো, এটা পাকিস্তানের অংশ হবে। তারা তখন থেকেই নিজেদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া শুরু করে। আর পাকিস্তান সৃষ্টির পরে অর্থাৎ ৪৭ থেকে শুরু করে গোটা পঞ্চাশের দশক ধরে যে উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণী এখান থেকে চলে যায়- নানা ভাবে তাদের কিছু অংশকে জেনে এবং বিভিন্ন স্মৃতিচারণ ও বাস্তবতা জেনে বোঝা যায়- তারা তাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজম্মের সামাজিক অবস্থানগত ও সংস্কৃতগত অবস্থান চিন্তা করেই এ দেশ ত্যাগ করেছিলো। এবং এই শ্রেণীর দেশত্যাগ কিন্তু ১৯৫৫ এর আগেই মোটা দাগে শেষ হয়ে যায়। এরা সকলে মোটামুটি এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলো, এখানে যদি তারা থাকে তাহলে তাদেরকে নিঃসন্দেহে তার নিজ মানের থেকে কম সংস্কৃত লোকের দ্বারা শাসিত হতে হবে। এবং তারা ধরেই নিয়েছিলো এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্টির মধ্যে মিডল ক্লাসের সংখ্যা কম এবং এই মিডল ক্লাসের মানদন্ডটি বেশিভাগ অর্থ নির্ভর। আর যে কোন দেশ যেহেতু মিডল ক্লাসই নানান স্টেক নিয়ে দেশকে পরিচালিত করে -সেখানে মিডল ক্লাসের চরিত্রে সংকট থাকলে ওই দেশ স্থিতিশীল হয় না। তাই একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল দেশের সঙ্গে  শিক্ষিত ওই হিন্দু শ্রেণী নিজস্ব ভাগ্য জড়াতে চায়নি। এমনকি  যে সকল হিন্দু বড় রাজনীতিকদের ভারতে চলে যাবার সুযোগ ছিলো, তারপরেও তারা সাতচল্লিশে না গিয়ে কেন ৫৮ এর পরে যে চলে যায় -তারও মূল কারণ ছিলো তারা এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে  নিজেদের জড়ানো শুধু নয়, তারা মনে করেছিলো এই দেশ বা পাকিস্তান অস্থিতিশীলতা থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারবে না। যে কারণে যুক্তফ্রন্টের আমলে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ৭০ জন হিন্দু  সদস্য থাকলেও শেষ অবধি তাদের কয়েকজনই মাত্র এ দেশে মারা যান। বাদবাকীদের শশ্নান ভারতে বা অনান্য দেশে।

এছাড়া আরেকটি বড় অংশ চলে গেছে সামাজিক সংস্কৃতি বা নিজস্ব আচরণের কারণে। যেহেতু দীর্ঘ দিন যাবত হিন্দু সমাজ একটি বর্গভাগে বেড়ে উঠেছে। তাদের বিয়ে সহ নানা আচরণ এই বর্গ বা বর্ণ ভাগে চলে আসছে। হাজার বছরের এই আচরণ থেকে মানুষ সহজে বের হতে পারে না। এবং এটা তারা তাদের সামাজিক সংস্কৃতি হিসেবে ধরে নেয়। এই সামাজিক সংস্কৃতি রক্ষার তাড়নায়ও একটি শ্রেণী এখান থেকে ভারতে চলে যায়।

দাঙ্গা বা নিপীড়নের বাইরে এটাই ছিলো বাঙালি হিন্দুর শিক্ষিত শ্রেণীর  দেশত্যাগের অন্যতম বড় কারণগুলো। অন্যদিকে পুর্ব বঙ্গের নির্ম্ম বর্গীয় হিন্দুরা পড়ে যায় একটি কঠিন সমস্যায়।  কারণ ওই সময়ে তাদের ভেতর শিক্ষার হার খুবই কম ছিলো। তারা বেশি ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন, মাছ ধরা ও চাষ এবং নদী কেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলো। তাদের যে অংশ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে গেলো তাদেরকে এই ধরনের কাজ যেখানে হয় সেই পরিবেশে  না নিয়ে ভারত সরকার তাদের একটি বড় অংশকে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যায়। অন্যদিকে আসামে যারা গিয়েছিলো তারা বাঙালি খেদাও আন্দোলনের শিকার হয় ষাটের দশকে। সেখানেও একটি বড় অংশ আবার সর্বস্ব হারায়। তাই নিম্মবর্গীয় হিন্দুদের একটি অংশ যে কোন পরিবেশ মেনে নিয়ে এখানে টিকে থাকার চেষ্টা করে। এবং সরাসরি রিফিউজি না হয়ে ধীর ধীরে নিজের সুবিধা মতো মাইগ্রেশানের পথ নেয়। যা এই নীরব মাইগ্রেশানের অন্যতম একটি কারণ। এর বিপরীতে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতি বাস্তবে এতই অস্থিতিশীলতার ভেতর দিয়ে কেটেছে, যার ফলে রাষ্ট্র  এই সামাজিক সমস্যার দিকে নজর দেবার বিষয়টি চিন্তা করেনি বা তেমন তাদের সুযোগও ছিলো না।

তারপরেও ৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটে সমাবেশ দেখে বিস্মিত হই। শুধু যে সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হয় এজন্য নয়। যার ভেতর দুটো বিষয় সব থেকে বেশি নজর কাড়ে- সমাবেশের প্রায় নব্বই শতাংশ ছিলো তরুণ। এবং  সেখানে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত প্রায় সমান সমান। তাছাড়া ওই সমাবেশের বক্তারা শুধু নয়, ওই সকল সমাবেশে উপস্থিত অনেক তরুণ তরুণী ফেসবুক লাইভে বা টেলিভিশনে তাদের মনের কথা বলে। সেখানে তারা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করে, এই দেশ তাদের পিতৃভূমি বা মাতৃভূমি- তারা এ দেশ ছেড়ে যাবে না। তাদের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে, যা তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে পারে এই সরব ও নীরব নির্যাতন – তা এখনি বন্ধ করা হোক।

এই দুটো বিষয় পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশে হিন্দু সমাজে একেবারেই নতুন। কারণ নীরব মাইগ্রেশানের প্রথম যাত্রী থাকে তরুণরা। তারা দেশ ত্যাগ করে পরিশ্রম করে নিজেকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে। তারপরে তাদের পরিবারের প্রবীন সদস্যদের নিয়ে যায়। কিন্তু তার বদলে তরুণরাই এদেশে থাকতে চাচ্ছে এবং তারা মাইগ্রেশান বিরোধী বরং নিজ মাতৃভূমিতে নিজ অধিকার নিয়ে থাকতে চায়।

এমন দুটি পজিটিভ বিষয়ের অর্ন্তনিহিত সত্য খোঁজার চেষ্টা করেছি গত কয়েক মাস ধরে। সেই চেষ্টার ভেতর দিয়ে যে বিষয়গুলো সামনে আসে তা মোটামুটি এমন- গত ৭৮ বছরে এই ভূখন্ডে  বাঙালি মুসলিম সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে সেখানে চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের ওই ভাবনা রাখার সুযোগ নেই যে, বর্তমান বাঙালি হিন্দু সমাজ সুপিরিয়র। আর এটা এই তরুণদের মাথায়ও আসছে না। কারণ, তাদেরও একটি সংস্কৃতির রূপান্তর হয়েছে। তবে এই সংস্কৃতির দিকটার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে বিশ থেকে পঁচিশ বছরের ছেলে মেয়েরা যখন বড় হয়েছে সে সময়ে তারা দেখেছে, বাঙালি হিন্দু ভিসি হচ্ছে, বিচারপতি হচ্ছে, সচিব হচ্ছে, ব্যাংকের এমডি হচ্ছে ,আর্মি ও পুলিশে বড় পদ পাচ্ছে – অর্থাৎ যোগ্যতা থাকলে ধর্ম তার বাধা হচ্ছে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র সরাসরি সেই পাকিস্তানী ভাবধারা বা হিন্দু বিদ্বেষী ভাবধারায় নেই। তাই পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের প্রথম দিকের বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে এই তরুণ প্রজম্মের মানসিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। তারা মানসিকভাবে এই দেশের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়াতে হবে এভাবেই বেড়ে উঠেছে।

স্বাভাবিকভাবেই তাই তাদের সমাবেশগুলো আশান্বিত করেছিলো।মনে হয়েছিলো বাঙালি হিন্দু তরুণরাও একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। এবং তারা যে সন্ন্যাসীকে তাদের নেতা হিসেবে গ্রহন করেছে- সেই চিম্ময় দাসও তরুণ। তাছাড়া তাঁর বক্তব্য শুনেও মনে হয়, তাঁর উদ্দেশ্য হিন্দুরা যাতে এই দেশ ত্যাগ না করে সেটাই। এবং তাদের এই সমাবেশ ও তাদের বক্তব্য শোনার পরে এ ধারণাও করেছিলাম যে বাংলাদেশের মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী ছোট বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পাশে দাঁড়াবে।

কিন্তু এর বিপরীতে সন্ন্যাসী চিম্ময় দাসকে কেন গ্রেফতার করা হলো তার কোন সদুত্তর এখনও পায়নি। তবে এদের সমাবেশ নিয়ে ও বাঙালি হিন্দু নিয়ে ঢালাও ভাবে বর্তমান সরকার যেভাবে বিচার করছে এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়।

প্রথমে বলা হয়েছে তাদের প্রতি যে নির্যাতন করা হয়েছে তার মূল কারণ হিন্দুরা সকলে আওয়ামী লীগ করে। এই সরকারে অনেক ডিগ্রীধারী মানুষ আছেন। তারা নিজেরা বইও লিখেছেন। অতত্রব অনেক পড়াশুনা তারা করেছেন। তাই সারা পৃথিবীর মাইনোরিটি নিয়ে নিশ্চয়ই তাদের ধারনা আছে। মাইনোরিটিরা সব সময়ই নিরাপত্তা খোঁজে। ভারতে মুসলিম মাইনোরিটিরা কিন্তু সকলে কংগ্রেস করে  না। যেখানে তারা কমিউিনিস্ট কোন পার্টির কাছ থেকে বেশি নিরাপত্তা পায় সেখানে তারা তাদের সঙ্গে থাকে। যেখানে অন্য কোন আঞ্চলিক দলের বা নেতার  কাছে মর্যাদা পায় সেখানে তাদের সঙ্গে থাকে। তেমনি বাংলাদেশেও কিন্তু ফরিদপুরে যে হারে মাইনোরিটিরা আওয়ামী লীগ সমর্থক বগুড়াতে তা নয়। বগুড়াতে অনেকে হিন্দু বিএনপির সমর্থক, আবার রংপুরে জাতীয় পার্টির। তাছাড়া বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অনেক বড় বড় নেতাই তো বাঙালি হিন্দু। এছাড়াও রাষ্ট্রের  সংবিধান তো সকলকে তার রাজনৈতিক পছন্দ বেছে নেবার স্বাধীনতা দিয়েছে। ঠিক এমনি ভাবে দেখা যায় আমেরিকার সব এলাকার স্প্যানিশ বা মেক্সিকান ডেমোক্র্যাটের সঙ্গে থাকে না। তারা অনেক রাজ্যে বা টাউনশিপে রিপাবালিকানদের সমর্থক। ফ্রান্সেও সব মুসলিম এক রাজনৈতিক দল করে না।

অন্যদিকে কয়েকটি পত্র পত্রিকায় ও অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি লেখায় ইনিয়ে বিনিয়ে এই সমাবেশের “ জয় শ্রীরাম”  স্লোগানকে কেন্দ্র করে মন্তব্য করা হচ্ছে, এটা ভারতের বিজেপির স্লোগান। ভারতের বিজেপির হিন্দু সদস্যরা এ স্লোগান দেয় ঠিকই, তবে মনে রাখা দরকার, ভারতের রাজনীতিতে এই “রাম” নামটি প্রথম এনেছিলেন কংগ্রেস নেতা  মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী। মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী রাজনীতিবিদ হিসেবে তেমন বড় নন, তাঁর কারণেও ইংরেজ ভারত ছাড়েনি। তবে এই “ রাম”  নামটি রাজনীতিতে এনে উত্তর ভারতে তাঁর আন্দোলনকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই নিয়ে যেতে পারার মূল কারণটি কিন্তু ব্রিটিশ গবেষক ( দুঃখিত এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের নাম মনে করতে পারছি না আবার  তার বইটাও এ মুহূর্তে সংগ্রহ থেকে খুঁজে বের করতে পারলাম না) বলেছেন, তুলসিদাসী রামায়ন মূলত  উত্তর ভারতের একটি বিশাল এলাকার মানুষের কাছে “ বাইবেল” । তাই “রাম” চরিত্রটি তাদের কাছে যীশু’র মতো।

 

যারা বাংলাদেশে “জয় শ্রী রাম”  নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাদেরও বাঙালি হিন্দু সমাজকে জানা নিয়ে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। বাঙালি হিন্দু বাড়িতে সুর করে তুলসী দাসী রামায়নের বাংলা অনুবাদ কিছুদিন আগেও সন্ধ্যায় পড়া একটা এক ধরনের অলিখিত রীতি ছিলো। এখনও গ্রামে গায়ে আছে।  তাছাড়া সুনীতি কুমার চট্টোপধ্যিায় বাদ দেন,  যারা সৈয়দ মুজতবা আলী ভালোভাবে পড়েছেন তারা অন্তত জানেন,  বাঙালিরও তুলসি দাসী রামায়নের মতো নিজস্ব অনেকগুলো রামায়ন ছিলো। এমনকি নোয়াখালি ও চিটাগাং এর ডাইলেক্টে বাঙালির রামায়ন ছিলো।

আর এই মহাকাব্য রামায়নের প্রভাব বাঙালি হিন্দু সমাজ, পরিবার ও রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। বাঙালি হিন্দু পিতা মানেই সে চায় তার ছেলে রামের মত পিতৃভক্ত হোক, বাঙালি হিন্দু মাতা  চায় তার মেয়ে রামের মতো স্বামী পাক। আবার বাঙালি হিন্দু ছোট ভাই চায় তার বড় ভাই রামের মতো হোক আর সে যেন রামের অন্য ছোট ভাইদের মতো বড় ভাইয়ের ভক্ত হতে পারে। আবার বড় ভাইও চায় লক্ষ্মন এর মতো তার ছোট ভাই হোক। সর্বোপরি বাঙালি মেয়ের বিয়ের পরে বঁধু বিদায়ের সময় ওই মেয়ে যখন তার আত্মীয় স্বজনকে প্রনাম করে তখন স্বাভাবিক আর্শীবাদ হলো,  “ সীতার মতো সতী লক্ষী হও”  ।

এই বাস্তবতার বাইরে গিয়ে যারা বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু তরুণ, তরুণীদের এই নতুন জাগরণকে, দেশপ্রেমকে বুঝতে না পেরে এর ভেতর রাজনীতি খুঁজছেন, দমন, পীড়ন ও জেল জরিমানার পথ নিচ্ছেন- তারা মূলত বাংলাদেশে যে নতুন বাঙালি হিন্দু প্রজম্ম ৮ দশক পরে আত্মপ্রকাশ করেছিলো, তাদের যে নিজ দেশ কেন্দ্রিক জাগরণ ঘটেছিলো- সে চিন্তা ধারাকে ভিন্ন পথে ঠেলে দিচ্ছেন। ১৯৪৬ এর পরে এই প্রথম এ  ভূখন্ডে একটি নতুন বাঙালি হিন্দু প্রজম্ম গড়ে উঠেছিলো- যারা এই দেশেই থাকতে চায়;  তাদেরকে জোর করে ভিন্ন পথে ঠেলে দেয়া শুধু রাষ্ট্র ও সমাজের একটি সুযোগ নষ্ট নয়। দেড় থেকে পৌনে দুই কোটি মানুষকে রাষ্ট্র ও সমাজের বাইরে ঠেলে দেয়া। এত মানুষকে অস্বীকার করা কখনই সঠিক নয়- কারণ  জনসংখ্যার হিসেবে অস্টেলিয়া মহাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকে বেশি এরা।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024