ঠিক কুড়ি বছর আগের এক ২৬শে ডিসেম্বর। ভূমিকম্পটা কলকাতায় বসে ঠিক টের পাওয়া যায়নি। তবে একটা অদ্ভুত খবর নানা জায়গা থেকে আসতে শুরু করেছিল একটু বেলার দিকে – নানা জায়গায় পুকুর উপচে নাকি মাছ পাড়ে উঠে আসছে!
এটা কি নতুন কোনও গুজব? না। গুজব ছিল না সেটা।
দুপুরের মধ্যেই সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল যে, ভারত মহাসাগরে ঘটে গেছে এক মহাপ্রলয় – বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন সুনামি।
সেসময় পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এটা একেবারেই নতুন শব্দ।
তখনও জানি না যে ওই মহাপ্রলয়ের কয়েকজন জীবিত সাক্ষীর সঙ্গে আমার দেখা হবে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে, আর তাদের কাছে শুনতে হবে সেই বিভীষিকাময় ভোরের কাহিনী, প্রিয়জনের হাত ছেড়ে গিয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলি ততক্ষণে তামিলনাডুর ছবি দেখাতে শুরু করেছে, তবে তখনও অজানা যে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা-আচের সব থেকে কাছের যে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, সেই আন্দামান-নিকোবরে কী ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সুনামি।
লন্ডনের সহকর্মীদের অনেকেই তখন ছিলেন ক্রিসমাসের ছুটিতে, নানা জায়গায়। দ্রুত তাদের ডেকে আনা হয়।
এরপরেই ফোন আসে লন্ডন থেকে, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কোনও যোগাযোগের নম্বর দরকার।
ওই দ্বীপপুঞ্জের খবরাখবর খুব কম মানুষই রাখতেন সে সময়ে। তবে কলকাতার এক সিনিয়র সাংবাদিকের কাছ থেকে যোগাড় করা গেল কয়েকটি নম্বর। তবে ফোন যাচ্ছে না কারও কাছেই।
একটি নম্বর ছিল আন্দামানের প্রধান শহর পোর্ট ব্লেয়ারের সরকারি সাংবাদিক-সম্পাদকের। তার ল্যান্ড-ফোনটি চালু ছিল। তার কাছে পাওয়া গেল কিছু খবর।
টিভিতে সুনামি ছাড়া তখন আর কোনও খবর নেই।
ভয়াবহ কিছু ভিডিও দেখানো হচ্ছিল – কিছু ভারতের, কিছু ইন্দোনেশিয়ার। সেসবই দেখছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত।
মাঝরাতে, রাত বোধহয় রাত দেড়টা হবে, ফোন করে ঘুম ভাঙ্গালেন লন্ডনের সিনিয়র সহকর্মী মানসী বড়ুয়া। নির্দেশ এল ‘কাল সকালে আন্দামান যেতে হবে তোমাকে।’
রাত প্রায় দুটো, ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলাম সেসময়ের সরকারি বিমান সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তাকে।
জেনে নিয়েছিলাম যে সকাল থেকে পর পর দুটো ফাঁকা বিমান যাবে পোর্ট ব্লেয়ার – ত্রাণ নিয়ে যাবে আর সেখানে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করে আনবে।
তার কোনও একটাতে আমি যেতে পারি যাত্রী হিসাবে। এরপরের ফোন পোর্ট ব্লেয়ারের সেই সাংবাদিক সম্পাদক অসীম পোদ্দারকে – “আমি কাল সকালে পৌঁছাব।”
তিনি সেই সময়ে ছিলেন আন্দামান প্রশাসনের ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক।
রাতে আর ঘুম হয়নি, তবে পরের কয়েক সপ্তাহও যে ভালো করে ঘুমোতে পারব না, সেটা তখনও জানি না।
ভোরবেলা রেডিও যন্ত্রপাতি, জামাকাপড় নিয়ে রওনা হলাম অজানার উদ্দেশে।
টিকিট কেটে প্লেনে ওঠার সময়ে দেখি, যাত্রী আমি একাই!
একটা গোটা প্লেনে একা আমি – অদ্ভুত একটা অনুভূতি নিয়েই আকাশে উড়েছিলাম ২৭শে ডিসেম্বর ভোরে।
পোর্ট ব্লেয়ারের বীর সাভারকার বিমানবন্দরে নামার আগে যখন বিমানটা চক্কর কাটছিল, তখন নিচের শান্ত, সবুজ-নীল সমুদ্র দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে মাত্র একদিন আগে কী প্রলয় ঘটিয়েছে ওই শান্ত নীল জল!
বিমানবন্দরে নেমেই প্রথম যে সমস্যায় পড়লাম, সেটা হলো মোবাইল ফোন চলছে না! আসলে সেটাই ছিল শুরু – মোবাইল ফোন ছাড়া, ইন্টারনেট ছাড়া সংবাদ পাঠানোর যে অভিজ্ঞতা ওই কয়েক সপ্তাহ হয়েছিল, তা সারাজীবন মনে থাকবে।
ওই সাংবাদিক-সম্পাদক প্রাথমিক ব্রিফিং দিয়েছিলেন ক্ষয়ক্ষতির – তবে সেটা শুধুই পোর্ট ব্লেয়ারের কাছাকাছি অঞ্চলের। কারণ বাকি বিশাল দ্বীপপুঞ্জ সুনামির পর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
বিশেষত নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের যেসব অঞ্চলে জনবসতি আছে – ভারতীয় নৌবাহিনীর বড়সড় এয়ারবেস কার নিকোবর বা ভারতের শেষ ভূখণ্ড ক্যাম্পবেল বে, কাচাল, কামোর্তা, লাপাতি, মালাক্কা– কোনও এলাকার সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি তখনও।
ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাঙালি অধ্যুষিত চোলদারি নামের একটা গ্রামের দিকে। পোর্ট ব্লেয়ার শহর থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।
চোলদারির দিকে যেতে যেতেই নাকে এল দুর্গন্ধ। চারদিকে শুধুই জল– মাঝে মাঝে ভাসছে পশুর মৃতদেহ আর দেখা যাচ্ছে জলে ডুবে যাওয়া বাড়ি।
সেই চোলদারি গ্রামটিকে অবশ্য বছর দুয়েক আগে গিয়ে চিনতেই পারিনি প্রথমে। সেটা এখন ঝাঁ চকচকে এক শহরতলি।
পুরনো রেকর্ডিংগুলো খুঁজে এখন শুনতে পেলাম চোলদারির বাসিন্দা, ৭৪ বছর বয়সী সুলতা মধু সুনামি শুরু হওয়ার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন আমাকে।
পুরনো নোটবুক খুঁজে দেখতে পাচ্ছি, তার পরিচয় হিসাবে লিখে রেখেছিলাম ১৯৫০ সালে ১০ বছর বয়সে বরিশাল থেকে পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে এসেছিলেন তিনি। তারপর কলকাতা থেকে ‘মহারাজা’ জাহাজে চেপে অন্য শরণার্থীদের সঙ্গে আন্দামানে ঠাঁই হয়েছিল তার।
“সেদিন আমি চা খাচ্ছিলাম, তখনই ভূমিকম্প শুরু হয়। একটু পরে আমি ক্ষেতের ধান দেখতে যাই, পাশেই পুকুর। সেখানে দেখি মাছগুলো সব লাফিয়ে উঠে আসছে। পরে বুঝেছিলাম ভূমিকম্পে পুকুরের নিচের মাটি ফুঁড়ে সাগরের লবণ-জল ঢুকে গেছে।”
“এরপরেই বিশাল বিশাল ঢেউ আসতে দেখি। ছেলেরা বলেছিল দৌড়াও। কিন্তু ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দৌড়াব কী করে! এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম, ঢেউ এসে আমাকে আছড়ে ফেলে দেয়। তখনই অজ্ঞান হয়ে যাই।”
জলের তোড়ে ওই দূরের পাকা রাস্তায় ভেসে চলে গিয়েছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পরে অন্য মানুষরা আমাকে উদ্ধার করে সেখান থেকে,” বলেছিলেন মিসেস মধু।
চোলদারি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বড় নৌবাহিনীর ঘাঁটি কার-নিকোবরের লাপাতি গ্রামের বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী বি ভাসুদেভের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সুনামির বেশ কয়েক বছর পরে।
তিনি আমাকে বলেছিলেন ২০০৪ সালের সেই ভয়ঙ্কর সকালের ঘটনাক্রম।
“আমি এক সহকর্মীর সঙ্গে চা খেতে গিয়েছিলাম। আর আড়াই বছরের ছোট মেয়ে জ্যোতিপ্রিয়া আর আট বছরের বড় মেয়ে গ্রামের একটা মন্দিরে গিয়েছিল। হঠাৎই প্রচণ্ড ভূমিকম্প। সমুদ্র কয়েক কিলোমিটার পিছিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মেয়েদের নিয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড়তে শুরু করি আমি।”
“লাপাতি স্কুলের দিকে জঙ্গল আছে, সবাই সেদিকেই দৌড়চ্ছিল। আমি বড় মেয়েটার হাত ধরেছিলাম আর স্ত্রী ধরেছিলেন আড়াই বছরের ছোট মেয়েটাকে। প্রথম ঢেউটাতে জল প্রায় কাছে চলে এসেছিল,” বলছিলেন মি. ভাসুদেব।
“কিন্তু দুনম্বর ঢেউটা আছড়ে পড়তেই ছোট মেয়েটার হাত ছেড়ে গেল। প্রচণ্ড চিৎকার করে কাঁদছিল বাচ্চাটা। ঢেউ সরে যাওয়ার পরে সেখানে শুধু বালি – মেয়েটা বোধহয় তার নিচেই চাপা পড়ে গেল,” যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেছিলেন, “ততক্ষণে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে – একটা টিনের আঘাতে স্ত্রীও ভেসে গেল – শুধু বলেছিল আমি চললাম – মেয়েটাকে দেখ। বড় মেয়েটার হাত ধরে সামনের একটা বড় নিম গাছে চড়ার চেষ্টা করছিলাম, তখন দেখি এক প্রতিবেশীর ছোট বাচ্চা মেয়েটাও সামনে চলে এসেছে– তার মা-ও ভেসে গেছেন। নিজের আর প্রতিবেশীর মেয়েকে গাছে তুলে সেখানেই বিকেল পর্যন্ত বসে ছিলাম আমি।”
এক সপ্তাহ পরে মেয়ের হাত ধরে নানা ত্রাণ শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয় মি. ভাসুদেভের। তার কাছেই খবর পান যে তার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
একমাত্র জীবিত মেয়ের হাত ধরে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বি ভাসুদেভ। জানতে পারেন, যেখান থেকে ভেসে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী, সেখান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে উদ্ধার করা হয়েছিল তাকে।
লাপাতি গ্রামেরই যুবক রভি। একটা টেলিফোন বুথ চালাতেন তিনি। সুনামির সময়েই জঙ্গলের দিকে পালিয়েছিলেন।
ঘণ্টা তিনেক পরে জল ভেঙ্গে নিজের বাড়ীর অবস্থা যখন দেখতে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চারদিকে শুধু চেনা- আধা চেনা মানুষের মৃতদেহ।
প্রথমদিন চোলদারি গ্রাম থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে ফেরার সময়ে দেখছিলাম প্রতিটা ফোন বুথের সামনেই লম্বা লাইন।
জীবিত মানুষরা তখন দেশের মূল ভূখণ্ডে ফোন করার চেষ্টা করছেন, পরিবারকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে বেঁচে আছেন তিনি।
আমাকেও ঘণ্টা দুয়েক লাইনে দাঁড়িয়ে খবর পাঠাতে হয়েছিল প্রথম দিন।
যে হোটেলে ছিলাম, তারা বলেই দিয়েছিলেন যে বারে বারে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে, রাতে সাবধানে থাকতে হবে।
একটা টেলিফোন কাজ করছিল, তা দিয়েই সংবাদ পাঠাতে শুরু করি – ইন্টারনেট তখনও নেই।
সেই প্রথম রাত থেকেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে কাজের যন্ত্রপাতি, টাকার ওয়ালেট সঙ্গে নিয়ে ঘুমানোর।
মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠত হোটেল ভবন – আর দৌড়ে সবাই বাইরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম। এতটাই মনের মধ্যে ‘কম্পন’-এর ভয় বাসা বেঁধে গিয়েছিল যে আন্দামান থেকে ফিরে আসার বেশ কয়েকমাস পর পর্যন্তও আমি ঘুমের মধ্যে ‘শেক’, ‘শেক’ (ভূমিকম্প) বলে চেঁচিয়ে উঠতাম।
পাশের একটি হোটেল এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে সেখানকার আবাসিকরা কেউ রাতে ঘরে থাকার ঝুঁকি নিতেন না।
রাস্তাতেই গদি পেতে দিত ওই হোটেলের কর্মীরা -পর্যটকরা সেখানেই ঘুমাতেন কোনমতে।
কয়েকদিন পরে সকালে খবর পেলাম ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটা বড় এয়ারক্রাফ্ট যাবে ক্যাম্পবেল বে পর্যন্ত। ভারতের শেষ ভূখণ্ড ক্যাম্পবেল বে-তে সেটাই প্রথম উদ্ধারকারী বিমান যাবে।
সেই আইএল ৭৬ বিমানে চেপে পৌঁছিয়েছিলাম ক্যাম্পবেল বে-তে।
বিমানঘাঁটির রানওয়েতে তখন বহু মানুষ অপেক্ষা করছেন এই আশা নিয়ে যে বিমানে চাপিয়ে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হবে।
বিমানবাহিনীর এক কর্মী আমার সাংবাদিক পরিচয় শুনে এগিয়ে এসে বললেন, “পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় আমার বাড়ি। দয়া করে একটা ফোন করে খবর দেবেন যে আমি বেঁচে আছি!”
সেদিন অনেক রাতে পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে তার বাড়িতে ফোন করে খবরটা দিতে পেরেছিলাম। বিশ্বের তৃতীয় সবথেকে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প আর ভয়াবহ সুনামির তিনদিন পরে ঘরের ছেলে যে বেঁচে আছে, সেটা জানাতে পেরেছিলাম।
স্থানীয় এক যুবকের মোটরসাইকেলে চেপে চলে গিয়েছিলাম ধ্বংসাবশেষ দেখতে, যদিও বিমানবাহিনীর অফিসারেরা বারবার বলে দিয়েছিলেন যে বেশি দূরে যেন চলে না যাই আমরা।
একটা চার্চ চোখে পড়েছিল – কয়েকদিন আগেই পালিত হওয়া ক্রিসমাসের নানা সাজ তখনও দেখা যাচ্ছে, তবে চার্চ ভবনটা মাঝখান দিয়ে দুভাগ হয়ে গেছে, জানলা, দরজা নেই, চার্চের ভেতরের চেয়ার, আলমারি উড়ে এসে পড়েছে রাস্তায়।
চারদিকে দুর্গন্ধে বমি উঠে আসছিল। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে মানুষের কথা শুনছিলাম।
হঠাৎই চোখে পড়ল একটা রাস্তা নির্মাণের বড় রোডরোলার উল্টিয়ে পড়ে আছে, নিচে চাপা পড়েছে একটা গাড়ি।
কয়েকজন যুবক বললেন, ওই রোলারটা ছিল সমুদ্রের ধারে একটা সরকারি জমিতে – প্রায় দুই কিলোমিটার ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে অতিভারী ওই রোলারটি।
গণেশ নামে এক স্থানীয় দোকানদার জানিয়েছিলেন, “বহু মানুষ সুনামিতে ভেসে চলে গেছেন আমরা কয়েকজন কপাল জোড়ে বেঁচে গেছি। মৃতদেহ এখানে দেহ দেখা যাচ্ছে না, তবে আশপাশের দ্বীপগুলিতে বালিতে চাপা পড়ে আছে সেসব।”
চারদিকে জল, তবে খাওয়ার জল নেই কোথাও। সাংবাদিকদের দেখে কয়েকজন সেই ক্ষোভ উগরিয়ে দিয়েছিলেন।
কয়েক ঘণ্টা পরে বিমানটি ফিরতি পথ ধরল – এবার মাঝপথে থামবে আন্দামান-নিকোবরের সবথেকে বড় বিমানঘাঁটি কার-নিকোবরে।
সেই বিমানঘাঁটি দেখে মনে হচ্ছিল যেন শত্রুপক্ষের বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে। কর্মী-অফিসারদের আবাসন, এমনকি সেখানকার তৎকালীন কমান্ডার – উইং কমান্ডার ভিভি ব্যানার্জীর বাংলো ধুলোয় মিশে গেছে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার ভেঙ্গে পড়েছে। ওই বিমানঘাঁটিতেই একশোরও বেশি বিমানবাহিনীর কর্মী-অফিসার মারা গিয়েছিলেন সুনামিতে।
উইং কমাণ্ডার ব্যানার্জী আমাকে বলেছিলেন, “গ্রামের পর গ্রাম ধুয়ে মুছে গেছে। এই বিমানঘাঁটি একেবারে শূন্য থেকে আবারও গড়ে তুলতে হবে আমাদের।”
তার কর্মী-অফিসারেরা কিন্তু থেমে ছিলেন না।
রানওয়েতে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষকে লাইন করিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন তারা। এদের অনেকে চারদিন ধরে অপেক্ষা করছেন একই জায়গায় – কখন বিমানবাহিনী উদ্ধার করে নিয়ে যাবে!
ওদিকে আইএল-৭৬ বিমান থেকে ত্রাণ সামগ্রী নামানো হচ্ছিল। স্থানীয় যারা ত্রাণ সামগ্রী নামানোর কাজে এগিয়ে আসছিলেন, তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে বিমানে আগে ওঠার সুযোগ পাবেন তারা।
বিমান বাহিনীর এক তরুণ অফিসার বলছিলেন, “তিন দিন ধরে স্নান করতে পারি নি। সামান্য খাবার জুটছে আমাদের। আর এই মানুষগুলোও বলতে গেলে না খেয়েই লাইন করে বসে আছে।”
সন্ধ্যে হয়ে আসছিল তখন। ফিরতি বিমানে চেপে পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরেছিলাম সুনামিতে বেঁচে যাওয়া বহু মানুষের সঙ্গে – বিমানের মেঝেতে বসে।
নানা ধরনের খবরাখবর সংগ্রহ করে বিবিসি রেডিওর জন্য পাঠানো তখন এক যুদ্ধ ছিল রীতিমতো। প্রথম পাঁচ ছয় দিন সেই লড়াই করার পরে সন্ধান পেলাম একটি সরকারি দফতরের ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে।
সেখানকার কর্মকর্তা আবার আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র। সেই ব্যবস্থা করে দিল যাতে আমি, এবং শুধু আমিই তার দফতরের ইন্টারনেট ব্যবহার করে খবর পাঠাতে পারি।
এদিকে হোটেলেও স্নানের জল নেই পর্যাপ্ত। তাই ঘামের গন্ধ ঢাকতে বোতল বোতল সুগন্ধি কিনছি। এক লিটার খাবার জলের দাম পৌঁছিয়েছে ৫০ টাকায় – যেটার আসল দাম ২০ টাকা।
এরই মধ্যে চলে এল ৩১শে ডিসেম্বর – শুরু হবে নতুন বছর।
মাঝরাতের একটু আগে গিয়েছিলাম পোর্ট ব্লেয়ারেরই এক ত্রাণ শিবিরে।
নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে দলে দলে সুনামি-পীড়িতদের সেখানে নিয়ে আসা হচ্ছে তখন।
একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, হাতে তার মামার দেওয়া একটা ছোট্ট পুতুল ধরা ছিল।
তার চোখের দৃষ্টিটা কীরকম যেন শূন্য লেগেছিল। সে আমাকে নির্লিপ্তভাবে বলেছিল কীভাবে ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার বাবা-মাকে।
প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করেছিলেন।
পাশে বসেছিলেন আরেক যুবক।
তার সঙ্গে কথা বলতে যাব, এমন সময়ে পাশের গির্জাঘর থেকে ঢং ঢং করে বেজে উঠেছিল রাত বারোটার ঘণ্টা–নতুন বছরের সূচনা ঘোষণা করে।
শক্ত সমর্থ ওই যুবক কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সেদিন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “আর নতুন বছর – আমাদের তো সব শেষ।”
এতগুলো বছর পরে তারা শোক হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, নতুন করে জীবনও শুরু করেছেন আন্দামান নিকোবরের বাসিন্দারা। পর্যটকরা আবারও হাজারে হাজারে পৌঁছন ওই দ্বীপ-ভূমিতে।
পোর্ট ব্লেয়ারের সুনামি স্মারকে অবশ্য পর্যটকরা খুব বেশি যান না।
তবে বি ভাসুদেভ আর তার স্ত্রী ছোট মেয়ের জন্মদিনে প্রতিবছরই নতুন জামাকাপড় নিয়ে হাজির হতেন একটা সময়ে সেখানে।
তার কোনও ছবিও নেই মি. ভাসুদেভের পরিবারের কাছে। সে শুধুই একটা নম্বর – সুনামি স্মারকে ৫৫৭ নম্বরে নাম আছে আড়াই বছরের জ্যোতিপ্রিয়ার। বেঁচে থাকলে আজ সে হয়ে উঠতো ২২ বছরের তরুণী!
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply