বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

নিপাহ ভাইরাসঃ আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সাবধানতা ও সচেতনতা

  • Update Time : শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০.০০ পিএম
হাসান মাহমুদ শুভ 
নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে একটি ভাইরাসজনিত জুনোটিক ডিজিজ অর্থাৎ প্রাণীদের দেহ থেকে মানবশরীরে সংক্রমিত হওয়া ডিজিজ। যদিও নানা প্রাণী থেকে এ রোগ হতে পারে কিন্তু এদের মধ্যে সবার আগে বাদুড়ের নামটা চলে আসে। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এই রোগ।
এ রোগের মৃত্যুর হার অনেক বেশি(৪০-৭৫%)।
মেরু অঞ্চল আর মরুভূমি বাদ দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ১৪০০ প্রজাতির বাদুড়।
শীতের আগমন মানেই যেন খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার এক বিলাসী প্রতিযোগিতা শুরু হয়।আমরা জানি,খেজুরের কাঁচা রসের সাথে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
আর এই বিলাসী প্রতিযোগিতা আমাদের জন্য মরণব্যাধি হয়ে উঠে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং পাঁচজনই মারা গেছেন। ড. কো বিং চুয়া ১৯৯৯ সালে শুকরের শরীরে প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করেন। সেই সময় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার শুকর খামারিদের মধ্যে এক ধরনের এনকেফালাইটিস অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্রাণঘাতী প্রদাহ দেখা দিয়েছিল যার ফলে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের শুকর রপ্তানিশিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কামপুং সুংগাই নিপাহ নামের যে গ্রামে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাস শনাক্ত হয় সেখান থেকেই ভাইরাসের নামকরণ। বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে, আর তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই এই দেশে নিপাহর আউটব্রেকের ঘটনা ঘটে চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এই রোগের কোন ভ্যাকসিন বা স্পেসিফিক ট্রিটমেন্ট নাই!কিন্তু রোগীর পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাপোর্টিভ কেয়ার দেওয়া হয়।
নিপাহ নির্ণয়ের জন্য কোভিডের মতো আমাদের নির্ভর করতে হয় আর. টি-পিসিআরের উপর, তবে এলাইজার মাধ্যমেও নিপাহর এন্টিবডি শনাক্ত করা সম্ভব। নিপাহর যেহেতু কার্যকর কোন চিকিৎসা নেই কাজেই বাঁচতে হলে মানতে হবে সচেতনতা ও সাবধানতা। নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কেউ কেউ উপসর্গহীন থাকতে পারে, কারো আবার শুধু সাধারণ জ্বর-কাশি দেখা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো, যখন মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা এনকাফালাইটিস দেখা দেয়। নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পাঁচ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড  জ্বর, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেটে ব্যথা, বমিভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এই রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস-জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে; ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীন এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর যারা বেঁচে যায়, তারা অনেকেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না, এমনকি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে চিরতরে।এমন পরিস্থিতিতে স্পষ্ট দৃশ্যমান যে,সচেতনতা ও সাবধানতার বিকল্প নেই। খেজুরের কাঁচা রস কোনভাবেই পান করা যাবে না। খেজুরের গুড়, রান্না করা খেজুর রসের পায়েস, পিঠা খাওয়া নিরাপদ। কারণ ৭০° সে. বা তার বেশি তাপমাত্রায় নিপা ভাইরাস কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। গাছ থেকে খেজুর রস সংগ্রহের হাঁড়ি জাল বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। কোনভাবেই যেন বাদুড়ের লালা,মল, মূত্র খেজুর রসের সাথে মিশে না যায় সেদিকে সর্বোচ্চ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে পাশাপাশি খেজুর রস সংগ্রহকারী গাছিয়া কে সতর্কতার সঙ্গে রস সংগ্রহ করতে হবে সেফটি মেনে। বাদুড়ে বা পাখি আংশিক খাওয়া ফলমূল খাওয়া যাবে না। বাজার থেকে ক্রয়কৃত ফল ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। নিপাহ ভাইরাসে আক্রমণ ব্যক্তির কাছে বিনা প্রয়োজনে কেউ যাবেন না। রোগীর সেবার জন্য মেডিকেল সেফটি মেনে সেবা করতে হবে। এক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিপাহ ভাইরাস রোগের লক্ষ্মণ  দেখা দিলে কালবিলম্ব না করে দ্রুততার সাথে নিকটস্থ সরকারি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে এবং রোগীতে সাহস দিতে হবে। আসুন, আমরা আতঙ্কিত না হয়ে সর্তক ও সচেতন হই তবেই মরণব্যাধি নিপাহ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
মেডিকেল শিক্ষার্থী ও ফিচার লেখক হাসান মাহমুদ শুভ 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024