প্রবীণ চক্রবর্তী
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জীবন এক স্বপ্নের মতো। সাধারণ জীবন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন, উচ্চতম সরকারি পদে আসীন হওয়া, বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি অর্জন, এবং বহু সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হওয়া—সব মিলিয়ে তার জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
তার উত্তরাধিকার নিয়ে যে কোনো আলোচনায় অবশ্যই তার দ্বারা অর্জিত উচ্চপদ এবং অসাধারণ পেশাগত কৃতিত্বের একটি দীর্ঘ তালিকা থাকবে। আধুনিক যুগের মেধা এবং যোগ্যতার প্রেক্ষাপটে তার অসাধারণ অর্জনই ড. সিংহের উত্তরাধিকার হিসাবে চিহ্নিত হবে।
তবে, আমার মতে, তার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হলো কঠিন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ রাজনীতি এবং জনসেবার পথে নৈতিকতার সঙ্গে অসাধারণ সাফল্য অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন। তিনি দেখিয়েছেন যে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য নয় নীতিহীনতা, অসততা, অহংকার এবং আত্মকেন্দ্রিকতা। ড. সিংহের সাফল্য তার আদর্শ এবং নীতির প্রতি অটল থাকার এক বিরল উদাহরণ। এটি তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে জনজীবনে প্রবেশ করার এবং দেশ গঠনে নিজেদের নিয়োজিত করার জন্য।
আমি সৌভাগ্যবান যে প্রায় এক দশক ধরে ড. সিংহের স্নেহ এবং সান্নিধ্য পেয়েছি। গত কয়েক বছরে, যখন তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং খুব বেশি বাইরে যেতে পারতেন না, তার সহধর্মিণী গুরশরণ কউর আমাকে নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বলতেন। আমি প্রায় প্রতি মাসে তার সঙ্গে দেখা করতাম এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতাম।
তার বসার ঘরে ব্যক্তিগত পরিসরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সদয়, এবং চিন্তাশীল। বাহ্যিক বিশ্বের কাছে তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি, কিন্তু নতুন তথ্য জানার এবং শেখার প্রতি তার কৌতূহল ছিল অশেষ।
২০১৬ সালে নোটবন্দির পরদিন, একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হওয়া সত্ত্বেও, তিনি বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং তারপরে তার মতামত গঠন করেছিলেন। এটি ড. সিংহের দেশপ্রেম এবং মানুষের কল্যাণের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
তার দায়িত্ববোধ ছিল অভাবনীয়। শেষ কয়েক বছরে শারীরিকভাবে দুর্বল অবস্থাতেও তিনি কংগ্রেসের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য দপ্তরে গিয়েছিলেন এবং সংসদে তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ইতিহাস ড. সিংহকে আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের একজন হিসেবে গণ্য করবে। তিনি গভীরভাবে বুঝেছিলেন যে ভারতের মতো একটি জটিল এবং বৈচিত্র্যময় জাতি গঠন করার জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং ঐকমত্য তৈরির প্রয়োজন।
তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেল এবং সামাজিক কল্যাণ কাঠামো আজও ভারতের শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
ড. সিংহের জীবন গল্প দেখিয়েছে যে রাজনৈতিক নিরাশার মরুভূমিতে একটি প্রবাহমান মরূদ্যান থাকা সম্ভব। সততা, বিনয়, এবং সেবার রাজনীতি টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, তার জীবন আমাদের আশা জাগায়।
আমি প্রার্থনা করি যে তার আদর্শ চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবে।
Leave a Reply