বৃহস্পতিবার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, সচিবালয়ে অগ্নিকান্ডে মোট পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে৷ মন্ত্রণালয়গুলো হলো- যুব ও ক্রীড়া, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, স্থানীয় সরকার এবং সড়ক ও পরিবহন৷ পুড়ে যাওয়া পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রের মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথি অনলাইনে থাকার কারণে সেটি রিকভার (সংরক্ষণ) করা যাবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি৷ তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র সংরক্ষণ পুরোটাই অ্যানালগ পদ্ধতিতে হয়, এ মন্ত্রণালয়ের যে শাখাগুলোর নথি পুড়ে গেছে, সেগুলোর কতটুকু রিকভার করা যাবে তা নিরূপণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে৷
বিশ্লেষকেরা যা বলছেন
আগুনের ঘটনা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন৷ ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্ঘটনাজনিত শর্টসার্কিট হতে পারে, পরিকল্পিতভাবে শর্টসার্কিট দিয়ে আগুন সৃষ্টি করা যেতে পারে৷ এই আগুন দেখে মনে হচ্ছে না, স্বাভাবিক শর্টসার্কিট থেকে এটা হয়েছে৷ পরিকল্পিত শর্টসার্কিটের জন্য ওই ছয়তলায় থাকতে হবে না৷ আগে থেকে পরিকল্পনা করে দু’টি বৈদ্যুতিক তার একসঙ্গে লাগিয়ে বারুদ, গান পাউডার কিংবা কেমিক্যাল রেখে নিচে বৈদ্যুতিক প্লাগ অন করলে বৈদ্যুতিক স্পার্কের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে৷
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আরেক সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সচিবালয় তো রাষ্ট্রের ‘কী’ পয়েন্ট, কেপিআইভুক্ত এলাকা৷ যদিও এখানে আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছে৷ পিডাব্লিউবি কাজও করেছে৷ আবার কেন তাহলে আগুন লাগলো? আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এভাবে কখনো দুর্ঘটনার আগুন লাগে না৷ দুর্বৃত্তরা যখন আগুন লাগায় তখন একসঙ্গে একাধিক স্থানে আগুন লাগে৷ এমন দুর্বৃত্তায়নের আগুন আমি আগেও দেখেছি৷ এখানেও (সচিবালয়) তাই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ এটা শর্টসার্কিট না, আগুন লাগানো হয়েছে৷”
দাহ্যবস্তু না থাকার পরও আগুন কীভাবে ওপরে গেলো এমন প্রশ্ন তুলে আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, ‘‘এত দ্রুততার সঙ্গে ছয়তলার দুই প্রান্তে আগুন পৌঁছে যাওয়া এবং সেখান থেকে চারটি ফ্লোরে প্রসারিত হওয়া রহস্যজনক৷ কারণ সেখানে কোনো উচ্চ দাহ্যবস্তু, কেমিক্যাল ও ইলেট্রিক্যাল সংযোগ তেমন ছিল না৷ মাঝামাঝি লিফট থেকেও আগুন লাগার আশঙ্কা নেই৷ কারণ সেখানে করিডোর আছে, দুই প্রান্তে অফিসগুলোতে পৌঁছাতে গেলে কিছু জায়গা আছে সেখানে কোনো দাহ্যবস্তু নেই৷ ভবনের দুই প্রান্ত থেকে আগুন কীভাবে ওপরে গেল, এসব দেখে মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক কোনো আগুন নয়৷”
গান পাউডার ছিল কিনা খতিয়ে দেখছে ‘বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ’
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় গান পাউডার ব্যবহার হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতেই গঠিত তদন্ত কমিটিতে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷
বৃহস্পতিবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, মধ্যরাতে রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার উৎস কী? অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কি স্বাভাবিক দুর্ঘটনাজনিত নাকি নাশকতাজনিত, এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে৷ অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে গান পাউডার ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন৷
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে৷ এই বিষয়টি দেখতে একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞকে কমিটিতে রাখা হয়েছে৷
গান পাওডারের সন্দেহের বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সাবেক ইন্সপেক্টর শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আগুনে কোনো বিস্ফোরক ছিল কি না সেটা নিশ্চিত হতে উদ্ধার করা ছাইয়ের ফরেনসিক পরীক্ষা করালেই নিশ্চিত হওয়া যাবে৷ ফরেনসিক পরীক্ষায় বোঝা যায়, ওখানে কি ছিল৷ আমি যতদুর জানি, সিআইডি এই ফরেনসিক পরীক্ষার কাজ করছে৷”
জানা গেছে, সিআইডির একটির দল সচিবালয় থেকে ছাই সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে৷ এ বিষয়ে সিআইডির পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবুল কালাম আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরীক্ষার ফলাফল এখনও পাওয়া যায়নি৷ খুবই গুরুত্ব সহকারে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একটি দল এগুলো পরীক্ষা করছে৷”
কুকুরের মরদেহে সন্দেহ সমন্বয়কের
‘‘সচিবালয়ের আগুনে পোড়া কুকুরের মরদেহ বলে দেয় এটি একটি ষড়যন্ত্র” বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম৷
বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সারজিস আলম বলেন, ‘‘আগুন শুধু আমাদের দুই সহযোদ্ধা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের রুমে লাগানো হয়েছে৷ সেখানে কুকুরের মরদেহ প্রমাণ করে এটি ষড়যন্ত্র৷ সচিবালয়ে আমলারা খুনি হাসিনাকে বসিয়ে রেখেছিল৷ গণঅভ্যুত্থানের আগে কিছু আমলানামক দাস ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় শ্লোগান দিয়েছে খুনি হাসিনার পক্ষে৷ তারা এখনো সচিবালয়ে চাকরি করে৷ তারা চাকরি করলে সচিবালয় কীভাবে নিরাপদ থাকবে? হয় সাদা নইতো কালা৷ তাদের চেয়ারে বসিয়ে রাখলে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পাওয়া সম্ভব না৷ সে কারণে এখন অপকর্ম হচ্ছে, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন হচ্ছে৷’’
আগুনের কারণ অনুসন্ধানে একাধিক কমিটি
আগুনের কারণ উদঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করেছে সরকার গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি৷ পাশপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও অনুসন্ধান করছেন৷
এছাড়াও কী কারণে আগুন লেগেছে, তা যাচাইয়ে সিআইডি, র্যাব, পুলিশের বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহের চেষ্টা করছে৷ তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলও ছিল বলে জানা গেছে৷
Leave a Reply