সারাক্ষণ ডেস্ক
দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিমানবন্দরে রবিবার ১৮১ যাত্রী ও ক্রু বহনকারী একটি যাত্রীবাহী বিমান দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হলে অন্তত ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন বলে জাতীয় অগ্নি নির্বাপণ সংস্থা জানিয়েছে। এটি দেশটির অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সকালবেলার এই ঘটনায় দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩ মিনিটে রানওয়েতে অবতরণের সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি ঘটে মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, যা গুয়াংজু ও মোক্পো শহরের কাছাকাছি অবস্থিত। বিমানটি ছিল জেজু এয়ার ফ্লাইট ৭সিসি২২১৬, যা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে মুয়ানে আসছিল।
রানওয়েতে অবতরণের পর বিমানটি গতি কমাতে সক্ষম হচ্ছিল না বলে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে। বিমানটির নিচ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরোতে শুরু করার পর সেটি উচ্চগতিতে একটি দেয়ালে ধাক্কা খায়, যার ফলে আগুন ও ঘন কালো ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলী দেখা যায়।
এই দুর্ঘটনার কারণ এখনো স্পষ্ট নয়, তবে পরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবতরণের ছয় মিনিট আগে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পাইলটদের পক্ষীর সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তদন্ত সম্পন্ন হতে ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে মন্ত্রণালয় জানায়।
পরিবহন মন্ত্রী পার্ক সাং-উ বলেছেন, দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি করতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। নিহতদের পরিবারকে সহায়তা প্রদান এবং জনমনে নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করতে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা হবে বলে মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ছোই সাং-মক দুপুরে মুয়ানে পৌঁছেছেন এবং সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
রবিবার জেজু এয়ার তাদের ওয়েবসাইটে সিইও কিম ই-বে স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যেখানে দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। কিম বলেন, “এ মুহূর্তে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা কঠিন, আমরা সরকারি তদন্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি। তবে দুর্ঘটনার কারণ যাই হোক, একজন প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমি দায়িত্ব অনুভব করছি।”
গণমাধ্যম কেবিএস জানিয়েছে, উদ্ধার হওয়া দুজনকে মোক্পো শহরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুজনই বিমানকর্মী—একজন ত্রিশের কোঠার পুরুষ ও একজন কুড়ির কোঠার নারী। কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক নয় বলে কেবিএস উল্লেখ করেছে।
সিউলের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত জেজু এয়ার ২০০৫ সালে স্বল্পমূল্যের উড়োজাহাজ সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ৫০টি বিশ্ব নগরীর সঙ্গে সংযুক্তি স্থাপন করেছে। এর প্রধান আন্তর্জাতিক রুটগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, জাপান ও চীনের দিকে।
বিমানটি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা উড়ে অবতরণের আগে পৌঁছায় বলে ফ্লাইট ট্র্যাকিং সেবাগুলো জানায়।
পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমানে ক্রুসহ মোট ১৮১ জন ছিলেন। এদের মধ্যে ১৭৩ জন দক্ষিণ কোরিয়ান, দুজন থাই এবং ৬ জন ক্রু।
মুয়ান অঞ্চলে অনেক থাই শ্রমিক কৃষি খাতে কাজ করেন। থাই প্রধানমন্ত্রী পেতোংতার্ন চিনাওয়াত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “বিমান দুর্ঘটনায় যাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানাই।”
দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ল সামরিক আইন জারির চেষ্টা করার পর থেকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত রয়েছেন, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত রয়েছে।
ইউন ১৪ ডিসেম্বর অভিশংসিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সুকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্টের তিনটি শূন্য পদে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে মতানৈক্যের জেরে আইনপ্রণেতারা শুক্রবার হানকেও পদচ্যুত করেন। পরে অর্থমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ছোই সাং-মক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। রবিবার তিনি মুয়ানে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অতীতেও বেশ কিছু প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালের এপ্রিলে চীনা বাহক এয়ার চায়নার একটি ফ্লাইট বেইজিং থেকে আসার পথে কোরিয়ার গিমহে বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে ১২৯ জন নিহত হয়। ১৯৯৩ সালে সিওল থেকে মোক্পো যাওয়ার পথে অ্যাসিয়ানা এয়ারলাইন্সের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে ৬৬ জন নিহত হয়।
১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর কোরিয়ান এয়ার লাইন্স ফ্লাইট ০০৭ নিউইয়র্ক থেকে সিওলে যাচ্ছিল (আলাস্কার অ্যাংকারেজে যাত্রাবিরতি করে) এবং সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর গুলিতে সেটি বিধ্বস্ত হয়। সেই ঘটনায় উড়োজাহাজে থাকা ২৬৯ জনই নিহত হন।
১৯৯৭ সালের আগস্টে কোরিয়ান এয়ার-এর একটি উড়োজাহাজ গুয়াম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়ে ২২৮ যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ইনছন থেকে সানফ্রান্সিসকোতে যাওয়ার সময় অ্যাসিয়ানা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট নামতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আগুন ধরে যায়, তাতে তিনজন নিহত হন।
Leave a Reply