স্টাফ রাইটার
ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো অল্প কয়েকটি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে যারা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশীয়ভাবে উন্নত এই প্রযুক্তি ভারতের প্রতি অঞ্চলে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর কৌশলগত সুবিধা অর্জনের প্রচেষ্টায় গতি আনবে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনকে “সতর্ক হয়ে উঠতে” বাধ্য করবে।
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) কর্তৃক উন্নয়নকৃত এই ক্ষেপণাস্ত্রটি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ১,৫০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লায় বিভিন্ন পেলোড বহনে সক্ষম বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব ওডিশা উপকূল থেকে প্রথম দীর্ঘ-পাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের “সফল ফ্লাইট-ট্রায়াল” সম্পন্ন হওয়ার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এটিকে “অসাধারণ সাফল্য” ও “বৃহৎ মাইলফলক” বলে অভিহিত করেন।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের বেগের চেয়ে পাঁচ গুণেরও বেশি গতিতে এবং উল্লেখযোগ্য গতিশীলতার সাথে উড়তে পারে, ফলে এগুলোর গতিপথ ও লক্ষ্যমাত্রা অনুমান করা কঠিন হয়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এগুলো অপেক্ষাকৃত নিচু উচ্চতায় উড়ে, যে কারণে সনাক্ত করাও বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
অনলাইন ডিফেন্স নিউজ সাইট ডিফেন্স.ক্যাপিটালের সম্পাদক ও প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এন. সি. বিপিন্দ্র বলেন, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাটি চীন ও পাকিস্তান—এই দুটি প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ভারতের অগ্রযাত্রার আরেক ধাপ। “এই ক্ষমতা পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে ভারতকে সহায়তা করবে, একই সঙ্গে চীনের অনুরূপ সক্ষমতার মোকাবিলায় সমপর্যায়ে নিয়ে যাবে।”
ন্যাটস্ট্র্যাট নামে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক স্বাধীন থিংক ট্যাংকের জ্যেষ্ঠ গবেষক রাজ কুমার শর্মা বলেন, অতি উচ্চগতির গতি, নিখুঁত লক্ষ্যভেদী ক্ষমতা, ব্যাপক পাল্লা, অল্প রেসপন্স টাইম এবং বাধা দেওয়া কঠিন হওয়ার কারণে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র যেকোনো সংঘাতেই “গেম চেঞ্জার” হয়ে উঠতে পারে। “শত্রুপক্ষের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এজাতীয় রক্ষামূলক শক্তিকে টার্গেট করে উচ্চগতির ও অনির্দেশ্য গতিপথের মাধ্যমে এগুলো ব্যবহৃত হয়।”
তবে বিপিন্দ্র যোগ করেন, “ভারতসহ সব রাষ্ট্রকেই হাইপারসনিক প্রযুক্তি নিয়ে আরো কাজ করতে হবে এবং সেই কাজ চলছে।”
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ওরেশনিক বা “হ্যাজেল” নামের একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম ব্যবহার দাবি করেছে। এটি গত নভেম্বর ইউক্রেনের দিনিপ্রো শহরে আঘাত হানতে ব্যবহার করা হয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এগিয়ে নিতে আরও সক্রিয় হতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। “ভারত যখন তার হাইপারসনিক সক্ষমতা দেখাল, এটি চীনের জন্যও বার্তা বয়ে নিয়ে গেল—যাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ভারতের তুলনায় আরও উন্নত—তাদের এখন সতর্ক হয়ে উঠতে হবে।”
পুনেভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ অ্যান্ড গ্রোথ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য উমা সুধীন্দ্র জানিয়েছেন, ভারত ২০০০ সাল থেকেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করে আসছে। “যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন যেভাবে তাদের উন্নত হাইপারসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, আমরাও একই লক্ষ্যে মনোযোগ দিয়েছি।
“ভারতের এই পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ আমাদের কৌশলগত সক্ষমতাকে বৈচিত্র্যময় করার এবং ঐতিহ্যবাহী যুদ্ধক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করে প্রতিরোধমূলক ভূমিকা জোরদার করার দিকেই ইঙ্গিত করছে।”
চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় লাদাখ এলাকায় চীনের সঙ্গে চার বছরব্যাপী সামরিক অচলাবস্থার অবসান ঘটানো হলেও, “ভারত চীনের মোকাবিলায় সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে” বলে মনে করেন বিপিন্দ্র।
তার ভাষায়, “ভারত চীনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, আর উভয়ের সম্পর্কের যে সাময়িক উত্তাপহ্রাস ঘটেছে তা সাময়িকই। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় চীন যে কোনো সময় আরেকটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পারে এবং ভারতকে তা প্রতিহত করতে সেরা সামরিক প্রযুক্তির প্রস্তুতি রাখতে হবে।”
ন্যাটস্ট্র্যাটের শর্মা নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, “চীন পাকিস্তানকেও এই প্রযুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে। পাকিস্তান ও চীনের ভূখণ্ড এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে, আর এই ক্ষমতা নিয়মিত শত্রুভাবাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।”
চীনের কাছে ইতোমধ্যেই এই সক্ষমতা আছে এবং দেশটি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কে নেই—এর অর্থ হচ্ছে “নয়াদিল্লি এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না,” বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ভারতের এই পরীক্ষা এমন একসময় অনুষ্ঠিত হলো, যখন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবস্থার পেছনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। একই সময়ে চীন দক্ষিণাঞ্চলীয় গুয়াংডং প্রদেশের ঝুহাই শহরে অনুষ্ঠিত এক বিমান প্রদর্শনীতে তাদের নতুন স্টেলথ ফাইটার জেট জে ৩৫এ প্রদর্শন করেছে।
চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম এই যুদ্ধবিমান কমিশন পেলে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন হবে দ্বিতীয় দেশ যার সক্রিয় বাহিনীতে দুটি পৃথক স্টেলথ ফাইটার জেট থাকবে। ইতোমধ্যেই দেশটির বিমানবাহিনীতে জে-২০ ভারী-ধরনের স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোতায়েন রয়েছে।
Leave a Reply