সারাক্ষণ ডেস্ক
২০২৪ সাল আমাদেরকে সমুদ্রবিশ্বে একাধিক অভূতপূর্ব আবিষ্কারের সাক্ষী করেছে। মাত্র পাঁচ শতাংশ সমুদ্র গবেষণার মাধ্যমে আমরা এখনো এর অসীম রহস্য উন্মোচনের খুব প্রাথমিক স্তরে আছি, আর আধুনিক সোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাত্র দশ শতাংশেরও কম ভূগর্ভস্থ মানচিত্র তৈরি হয়েছে। অথচ পৃথিবীর বৃহত্তম বাসস্থান—সমুদ্র, যা পুরো গ্রহের ৭০ শতাংশের বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত—প্রতি বছর নতুন নতুন তথ্য জানিয়ে যাচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে। ২০২৪ সালে সমুদ্রের জগৎ থেকে উঠে এসেছে এমন কয়েকটি বিস্ময়কর আবিষ্কার:
১) আটাকামা ট্রেঞ্চে নতুন ক্রাস্টেশান প্রজাতি
আটাকামা ট্রেঞ্চের প্রায় ৮,০০০ মিটার গভীরে আবিষ্কৃত হয়েছে এক ধরনের অ্যামফিপড, যার গায়ে ফ্যাকাশে সাদা আভা। স্থানীয় আন্দীয় ভাষায় ‘অন্ধকার’ বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এর নাম রাখা হয়েছে “ডুলসিবেলা কামানচাকা”। এই মাত্র ৪ সেন্টিমিটার লম্বা ক্রাস্টেশানটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিকার ধরতে ‘র্যাপ্টোরিয়াল অ্যাপেন্ডেজ’ ব্যবহার করে।
আটাকামা ট্রেঞ্চ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব পাশে অবস্থিত এবং সমুদ্রের গভীরতম ৪৫ শতাংশ অঞ্চলের অংশ। এই ট্রেঞ্চের কিছু কিছু জায়গা ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর।
২) পানির নিচের এক পর্বত
চিলির উপকূল থেকে প্রায় ১,৪৫০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রগর্ভে এমন একটি পর্বত আবিষ্কৃত হয়েছে, যার উচ্চতা প্রায় বুর্জ খলিফার চার গুণ। এই নতুন সি-মাউন্টে (পানির নিচের পর্বত) বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন বিচিত্র সব প্রাণী—যেমন ক্যাসপার অক্টোপাস, অদ্ভুত “ফ্লাইং স্প্যাগেটি মনস্টার” আর এমন মাছ যেগুলো দেখতে অনেকটা মাপেট চরিত্রের মতো।
বিজ্ঞানীরা ২৮ দিনের এক অভিযানে নাজকা রিজ ও সালাস ই গোমেজ রিজসহ বিভিন্ন সমুদ্রগর্ভস্থ পর্বতমালা অন্বেষণ করতে গিয়ে এই পর্বতটি আবিষ্কার করেন।
৩) উজ্জ্বল সমুদ্রগুগলি
সাধারণত সমুদ্রগুগলি (সি স্লাগ) অগভীর জলাভূমি, প্রবালপ্রাচীর ও অল্প গভীর তলের কাছে বাস করে। কিন্তু ২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা আলোহীন গভীর সমুদ্রের (মিডনাইট জোন) স্তরে একটি আলোকময় সমুদ্রগুগলি খুঁজে পান। প্রায় ২৫ বছর আগে প্রথম এই প্রাণীর দেখা মিললেও এতদিন এর পরিচয় সম্পূর্ণ পরিষ্কার ছিল না।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ১৮টি নমুনা পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে, এটি এতটাই ব্যতিক্রমী যে একে সম্পূর্ণ নতুন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। এর নাম রাখা হয়েছে “বাথিডেভিয়াস কড্যাকটিলাস”। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো একটি দ্বিখণ্ডিত লেজ, যা নিজেই আলো ছড়ায় এবং আক্রমণের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। আর এর শরীরের সামনের দিকে থাকা ‘হুড’ দিয়ে এটি জেটের মতো জল স্রোত বের করে চলাচল করে।
৪) চিলির উপকূল ঘেঁষে ১০০-র বেশি নতুন প্রজাতি
চিলির উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রগর্ভের পর্বতসমূহে অভিযান চালিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন সর্পিল আকৃতির প্রবাল, স্কোয়াট লবস্টার, অ্যামফিপড ও সি আরচিনসহ নতুন বহু প্রজাতি। এগুলো আগে কোনোদিন বিজ্ঞানের নজরে আসেনি।
গবেষকদের ধারণা, এত বিপুলসংখ্যক নতুন প্রজাতিকে সঠিকভাবে শনাক্ত ও শ্রেণিবদ্ধ করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
৫) ডার্ক অক্সিজেন
প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় ৪ কিলোমিটার গভীরে কোনো রকম সূর্যালোক ছাড়াই অক্সিজেন উৎপাদনের ঘটনা আবিষ্কৃত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে থাকা ধাতব গঠন বা ‘নডিউল’ থেকে এই অক্সিজেন তৈরি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এই অক্সিজেন গভীর সমুদ্রে অগণিত প্রাণীর বেঁচে থাকার পেছনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একইসঙ্গে এই নডিউলগুলোতে লিথিয়াম ও কপারসহ মূল্যবান ধাতু পাওয়া যায়, যা ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে গভীর সমুদ্র খনির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
৬) ‘স্যাসি স্পার্কলার’ সামুদ্রিক কৃমি
গভীর সমুদ্রের পলিকীট (পলিকিট) জাতীয় কিছু কৃমির দেহে নিজস্ব আলোকময় বা রঙিন কাঠামো থাকে। সাম্প্রতিক অভিযানে বিজ্ঞানীরা এমন একটি “স্যাসি স্পার্কলার” কৃমি আবিষ্কার করেছেন, যার দেহের সূক্ষ্ম শূলে বা ব্রিস্টলে থাকা প্রোটিন কাঠামো আলো প্রতিফলিত করে গোলাপি আভা তৈরি করে।
চিলি মার্জিন অঞ্চলে রোবট অনুসন্ধানযান ব্যবহার করে দেখা যায়, এই কৃমি নড়াচড়া করলে তার শরীর ঝিকিমিকি আলো ছড়ায়। গবেষকদের ভাষায়, “এই পলিকীটকে বর্ণনা করতে গেলে ‘জ্যাজ হ্যান্ডস’ দেখানো ছাড়া উপায় নেই!”
৭) ইউএসএস হার্ডার সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানি যুদ্ধজাহাজ সবচেয়ে বেশি ডুবিয়ে দেওয়ার রেকর্ড ছিল ইউএসএস হার্ডারের। এটি প্রায় আট দশক আগে ৭৯ জন নাবিকসহ ফিলিপাইনের উপকূলে এক যুদ্ধে নিখোঁজ হয়।
২০২৪ সালের মে মাসে দক্ষিণ চীন সাগরের লুজন দ্বীপের কাছে সমুদ্রতলে সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ মূলত অক্ষত ও খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
৮) সমুদ্রতলের নিচে প্রাণের অস্তিত্ব
বহুদিন ধরে ধারণা ছিল সমুদ্রতল থেকে আরও নিচে বড়জোর অণুজীবের অস্তিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ২.৫ কিলোমিটার গভীরে, যেখানে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টস্ প্রচণ্ড তাপযুক্ত জল নিঃসরণ করে, সেখানে বড় আকারের টিউবওয়ার্ম (রিফটিয়া প্যাকিপ্টিলা), শামুক ও বিভিন্ন ধরনের কৃমি বেঁচে থাকে।
এই ধরনের চরম পরিবেশে টিকে থাকার জন্য প্রাণীগুলোর মধ্যে অদ্ভুত অভিযোজন দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে দৈত্যাকার টিউবওয়ার্মের কোনো পাকস্থলী বা পরিপাকতন্ত্র নেই, তারা জায়গায় স্থির হয়ে বড় হয় এবং বেঁচে থাকতে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ অপরিহার্য। এভাবে ব্যাকটেরিয়া ও টিউবওয়ার্মের মধ্যে এক ধরণের পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়—কৃমি ব্যাকটেরিয়াকে রাসায়নিক শক্তি দেয়, আর ব্যাকটেরিয়া কৃমিকে খাদ্য সরবরাহ করে।
Leave a Reply