বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২২ অপরাহ্ন

কেন অনেক খ্রিস্টান এত নির্মম?

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩.৫৩ এএম

ডেভিড ফ্রেঞ্চ

আমি যেকোনো জায়গায় গেলেএমনকি খ্রিস্টান বন্ধুদের সঙ্গেওপ্রায়ই এই প্রশ্নটি শুনি: কেন এত খ্রিস্টান এত নির্মম আচরণ করে?

আমি অসংখ্যবার শুনেছি কেউ একজন বলছে, “আমি একাধিকবার ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে নানা প্রতিক্রিয়া পেয়েছিকিন্তু গির্জার ভিতরের ঘৃণা আমাকে আসলে স্তম্ভিত করেছে। খ্রিস্টানরা বিশেষভাবে রাগী হতে পারেএমনকি কখনো কখনো নিষ্ঠুরও।

এটি সহজ প্রশ্ন হলেও এর জটিল উত্তর রয়েছে। তবে সেই উত্তরের সূচনাপর্বই হলো এক ধরনের মোহময় প্রলোভনযা সব ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই বিরাজ করে: যারা শাশ্বত সত্যে বিশ্বাসীতারা যেন শাসন করার অধিকারী। এই ধারণায়ক্ষমতাই আসলআর যিনি ঠিকতিনিই ক্ষমতা পাওয়ার যোগ্য।

আমাদের বেশির ভাগের নৈতিক বোধ যথেষ্ট সুস্পষ্টতাই আমরা জানি যে ক্ষমতাই আসল” কথাটিকে অস্বীকার করতে হবে। নিছক শক্তি বা ক্ষমতা ধার্মিকতার চিহ্ন হতে পারে না। মানুষ ভয়ে বা বিস্ময়ে ক্ষমতার সামনে নত হতে পারে ঠিকইকিন্তু ক্ষমতাকে মেনে নেওয়া আর তাকে ন্যায়সংগত বা সঠিক বলে স্বীকার করা এক বিষয় নয়।

কিন্তু যিনি সঠিকতিনি ক্ষমতা পাওয়ার যোগ্য”—এই ধারণাটি ভিন্নআর সম্ভবত আরও বেশি ক্ষতিকারক। এটি আমাদের উচ্চাশাকে উসকে দেয় নৈতিকতার মোড়কেযা অত্যন্ত ছলনাময়। এটি নিজের অন্ধকার দিকটিকে আড়াল করে রাখে। ভাবনাটি এমন: যদি আপনি মনে করেন আপনার ধারণাগুলো সঠিক ও ন্যায়সংগততাহলে আপনি ক্ষমতায় না থাকলে সমাজের ক্ষতি হবে।

এই প্রেক্ষাপটে নিজের ক্ষমতার ইচ্ছা পবিত্র হয়ে ওঠে। এটি আর নিছক উচ্চাশা নয়বরং সমাজের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ। আপনি তো প্রতিবেশীদের মঙ্গলের কথাই ভাবছেনআর তাদের কল্যাণের জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছেআপনার নেতৃত্ব।

এমন মানসিকতার বাস্তব সমস্যা প্রচুর। আমরা আসলেই কতটা নিশ্চিত যে আমরা সঠিকআবার সত্যিই যদি আমাদের ধারণা ন্যায়নিষ্ঠ হয়ক্ষমতার লোভ প্রায়ই ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে ম্লান করে দেয়। ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ অগণিত। কারো হাতে যদি তলোয়ার তুলে দিয়ে বলা হয় যে সে ক্রুশের পক্ষে যুদ্ধ করছে,” তাহলে সে সীমাহীন ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।

এছাড়া, “যিনি সঠিকতিনি ক্ষমতা পাওয়ার যোগ্য”—এই ধারণার বিরুদ্ধে তাত্ত্বিকভাবেও আপত্তি রয়েছে। খ্রিস্টীয় মতবাদ অনুযায়ীযিশু হলেন ঈশ্বর ও মানুষনির্দোষ এক সত্তা। আমি পাপীআমি ত্রুটিপূর্ণকিন্তু তিনি নন।

কিন্তু যিনি ঈশ্বর-মানবযিনি নিখুঁততিনি ক্ষমতার প্রতি কী মনোভাব দেখিয়েছিলেনতিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেনকথায় এবং কাজেআর এই সবের সূচনা হয়েছিল ক্রিসমাসের মাধ্যমে।

যদি কেউ একজন আগত রাজাকে খুঁজতে চায়তবে সম্ভাব্য শেষ জায়গা হবে একটা গোয়ালঘর। কিন্তু সেই সাধারণ জন্মই তাঁর সাধারণ জীবনের পূর্বাভাস দিয়েছিলএবং গড়ে তুলেছিল যা আমার সাবেক পালক যাজক ঈশ্বরের উল্টোপথের রাজত্ব” বলে অভিহিত করতেন।

খ্রিস্টের বাণী ছিল স্পষ্টআর সেগুলো মানুষের উচ্চাশা ও আত্মঅহংকারের বিরুদ্ধে গিয়েছিল: “শেষজনই হবে প্রথম।” “ধনী ব্যক্তির পক্ষে স্বর্গে প্রবেশ করার চেয়ে সূচের ছিদ্র দিয়ে উট যাওয়া সহজ।” “যে কেউ আমার পেছনে আসতে চায়তাকে নিজেকে অস্বীকার করে তার ক্রুশ তুলে নিতে হবে।” “তোমরা তোমাদের শত্রুদের ভালোবাসবে এবং যারা তোমাদের নিপীড়ন করেতাদের জন্য প্রার্থনা করবে।

যিশুর কর্মও ছিল অনুরূপ। তিনি শুধু সাধারণ এক জন্মই লাভ করেননিসাধারণ পরিবারের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেনক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে। শৈশবে তিনি ছিলেন এক আশ্রয়প্রার্থী।

যখন তিনি তাঁর মন্ত্রণাদান শুরু করলেনতিনি বারবার এমন আচরণ করলেন যা আধুনিক কালের আন্দোলন গড়ার পদ্ধতির পরিপন্থীসাম্রাজ্য উল্টে দেওয়া তো দূরের কথা। তিনি ভিড় এড়িয়ে চলতেন। কোনো অলৌকিক কাজ করলে যাদের চিকিৎসা করতেনতাদেরকে বলতেন যেন কেউকে না জানায়। জীবনের শেষদিকে যখন তিনি বললেন, “কাইসারের যাকাইসারকে দাওআর ঈশ্বরের যাঈশ্বরকে দাও,” তখন তিনি কাইসারের মতো জায়গা নিজে দাবি করলেন নাউপরন্তু কাইসারের ক্ষমতার সীমাহীন দাবিকেও মেনে নিলেন না।

এরপর তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষার মুখে পড়লেনঅন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়ে। যেখানে সঠিক বানচাল হয়েছিল শক্তির কাছে। ঈশ্বরের পুত্র মানুষদের হাতে নির্যাতিত ও নিহত হয়েছিলেনযদিও তিনি চাইলে রোমানদের থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন।

যখন যিশুর জয় এলোতখন কাইসারকে পরাজিত করে নয়তিনি জয়ী হলেন মৃত্যুর উপর। পুনরুত্থানের পর স্বর্গে আরোহণকালে পৃথিবীতে রেখে গেলেন সেই কাইসারকেই সিংহাসনে।

শিশু হিসেবে বড়দিন বা ক্রিসমাস একসময় আমার কাছে ছিল শুধুই আনন্দের দিন। এখন তা গভীরভাবে আমাকে বিনয়ী করে। যিশুর জন্মের ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটেছেতা আসল ঘটনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেভাবে এসেছিলেনতা-ই ইঙ্গিত দেয় কেন তিনি এসেছিলেন: মানুষকে মুক্তি দিতেজাতি শাসন করতে নয়।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যউচ্চাশা প্রায়শই নির্মমতায় রূপান্তরিত হয়। নিজেকে আমরা মিথ্যা বিশ্বাস করাই যে আমরা শুধু সঠিক নইবরং এতটাই নির্ভুল যে আমাদের বিরোধিতাকারীরা নিশ্চয়ই অহংকার বা শয়তানী থেকে বিরোধিতা করছে। ফলে আমরা কঠোর হইশত্রুদের ধ্বংস’ করতে চাই। কিন্তু এসবই আমরা করি সমাজের স্বার্থে! তাই রাতে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। আমরা হয়ে উঠি সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তিএকজন নির্মম মানুষযার বিবেক পরিষ্কার।

খ্রিস্টের পথ এটার বিপরীত। সেখানে নিষ্ঠুরতার কোনো জায়গা নেইসেখানে প্রয়োজন করুণার। এটি আমাদের নৈতিক মানদণ্ডকে পাল্টে দেয়বা অন্তত পাল্টে দেওয়ার কথা। আমরা সাধারণত দারিদ্র্য থেকে বিত্ত’—এমন গল্প ভালোবাসি। ফলে অনেকেই যদি যিশুর গল্প লিখততারা হয়তো গোয়ালঘর দিয়ে শুরু করত ঠিকইকিন্তু শেষ করত সিংহাসনের দৃশ্য দিয়ে।

কিন্তু যিশুর জীবন শুরু হয়েছে গোয়ালঘরে এবং শেষ হয়েছে ক্রুশে। তিনি তাঁর অনুসারীদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তাদেরও এমন ক্রুশের মুখোমুখি হতে পারে। এই উল্টোপথের রাজত্বের শুরুটাই এমন উল্টোপথের এক জন্ম দিয়ে। যিশু নিজেই যখন বিনয়ীতখন কী করে আমরা আমাদের অহংকারকে ন্যায়সংগত বলে প্রতিষ্ঠা করি?

(লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024