কাং-কুক লি
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের অভিশংসনকে ঘিরে শিরোনাম চলছে, তবে উভয় দেশের সরকারই ধীরগতির প্রবৃদ্ধিকে চাঙা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১.৩% হারে ভালো প্রবৃদ্ধি করলেও পরের প্রান্তিকে ০.২% হ্রাস পায় এবং জুলাই-সেপ্টেম্বরে মাত্র ০.১% বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি ভোগ ও যন্ত্রপাতি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও নির্মাণ খাত ও রপ্তানি কমে যাওয়ার ফলে কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (কেডিআই) ২০২৪ সালের বৃদ্ধির পূর্বাভাস ২.৫% থেকে কমিয়ে ২.২% করেছে।
এর মধ্যে জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার সম্ভাবনা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে। তার শক্তিশালী সুরক্ষাবাদী নীতিমালা – যেখানে ১০% থেকে ২০% পর্যন্ত সর্বব্যাপী শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি রয়েছে – রপ্তানিনির্ভর দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিকে গভীরভাবে আঘাত করতে পারে।
এছাড়া ট্রাম্প ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (আইআরএ)-এর আওতায় সবুজ শিল্প ও অর্ধপরিবাহী খাতে যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা নির্মাণকারী কোম্পানির ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যা দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় কোম্পানির জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মানদণ্ডমূলক কেওএসপিআই সূচক প্রায় ৯% কমেছে এবং ডলারের বিপরীতে ওনের মান ৮% কমে গেছে। বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁজিবাজার ও মুদ্রা সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা দেখিয়েছে। কেডিআই ২০২৫ সালে মোট ২% প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, যার প্রধান কারণ রপ্তানিতে স্থবির অবস্থা। বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো আরও নেতিবাচক ধারণা করছে। গোল্ডম্যান স্যাকস ১.৮% প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
সরকার যিনি-ই পরিচালনা করুন, ইউন বা অন্য কেউ, অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার লক্ষ্যে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। সরকার ধারাবাহিকভাবে রক্ষণশীল রাজস্ব নীতিতে অটল থেকে ব্যক্তিগত খাতকে বড় ভূমিকা দিতে ও সরকারি অর্থ পরিচালনায় কড়া নিয়ম বজায় রাখতে চায়। ২০২৪ সালে সরকারি ব্যয় বেড়েছে ২.৮%, যা দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালে বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৩.২%, যা মনোনীত জিডিপি বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম।
সরকার একদিকে রাজস্ব ঘাটতি ও সরকারি ঋণ কমানোর কথা বলছে, আবার অন্যদিকে করপোরেশন ও বিত্তবানদের কর ছাড় দিচ্ছে – যা পুরনো সময়ের ‘ট্রিকল-ডাউন’ অর্থনীতির নীতি। ফলস্বরূপ রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যা আরও বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রায় ৫৬ ট্রিলিয়ন ওন (প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার), অর্থাৎ মোট জিডিপির প্রায় ২.৫% ঘাটতি হয়েছে বাজেটের তুলনায়। ২০২৪ সালেও প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ওন ঘাটতি হতে পারে।
অন্যদিকে জাপানের অর্থনীতি ধীরলয়ে পুনরুদ্ধারের দিকে এগোচ্ছে এবং সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির হার দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় সামান্য বেশি। বছরের প্রথম তিন মাসে ০.৬% হ্রাস পেলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ০.৫% এবং তৃতীয় প্রান্তিকে ০.২% হারে প্রবৃদ্ধি পেয়েছে।
এ পুনরুদ্ধারের পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিল বেসরকারি ভোগ, যা তৃতীয় প্রান্তিকে ০.৯% বেড়েছে, যদিও বিনিয়োগ সামান্য কমেছে এবং রপ্তানিতে ০.৪% পতন হয়েছে। ভোগের এই পুনরুত্থান মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ বছরের বার্ষিক ‘শুন্তো’ মজুরি আলোচনায় মজুরি নামমাত্র ৫.৬% বেড়েছে, যা গত ৩৩ বছরে সর্বোচ্চ।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব হিসাব করলে প্রকৃত মজুরি টানা ২৬ মাস নেতিবাচক ছিল মে পর্যন্ত, কিন্তু জুনে প্রথমবারের মতো ইতিবাচক হয়। দেশীয় চাহিদা জিডিপির সবচেয়ে বড় অংশ, তাই মজুরি ও পরিবার-আয়ের স্থায়ী প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে লক্ষ্য রাখার বিষয়, আগস্টে আবার প্রকৃত মজুরি হ্রাস পেতে শুরু করে। আইএমএফ অক্টোবর মাসে জাপানের ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ০.৩% এবং ২০২৫ সালের জন্য ১.১% নির্ধারণ করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান উভয়েই ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মুখে রয়েছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের আয় বেড়েছে, ডলার শক্তিশালী হয়েছে। নতুন মার্কিন প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতি আগামী বছরে পূর্ব এশিয়ার সরকারগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
দুটি দেশেই অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো প্রয়োজন: জাপানে মজুরির বাস্তব বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় আরও সক্রিয় রাজস্ব নীতি গ্রহণ।
২২ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ান সরকার অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সহায়তার জন্য একটি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যা হয়তো আরও সক্রিয় আর্থিক নীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে।
একই দিনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা দেশের আর্থিক দুরবস্থা সত্ত্বেও ২১.৯ ট্রিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলার) সরকারি ব্যয়ের একটি অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ১০.৪ ট্রিলিয়ন ইয়েন অর্থনীতিকে চাঙা করা ও মজুরি বাড়াতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে; কোম্পানিগুলোকে মজুরি বাড়াতে সহায়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে বিদ্যুৎ ও পেট্রোলের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য ভর্তুকি, ৩০,০০০ ইয়েন নগদ সহায়তা এবং নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে অতিরিক্ত শিশু সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
ইশিবা জোর দিয়েছেন যে, এখনকার পাশাপাশি ভবিষ্যতেও স্থায়ী মজুরি ও আয়ের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা জরুরি। তবে জাপানে বিশেষত দুর্বল অবস্থানে থাকা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকার সত্যিই তার রক্ষণশীল, ‘ট্রিকল-ডাউন’ অর্থনীতির নীতি থেকে সরে আসবে কি না, সে বিষয়ে ব্যাপক সংশয় রয়েছে।
২০২৫ সালটি উভয় দেশের সরকারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে – বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়া যখন রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে এবং জাপান সংখ্যালঘু লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে পথ চলছে।
রিতসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, জাপান
Leave a Reply